পতেঙ্গার সাগরপাড়ে ফেলা হচ্ছে ক্লিংকারের বিষাক্ত বর্জ্য, ভেসে আসছে মরা মাছ

বন্দরের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ বিধ্বংসী কাণ্ড

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অনুমতি নেওয়া ছিল শুধু জায়গা ব্যবহারের, অথচ ওই অনুমতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রকাশ্যে বঙ্গোপসাগরের কিনারায় ফেলা হচ্ছে জাহাজের ক্লিংকার বর্জ্য। কিনারা থেকে এসব বিষাক্ত বর্জ্য সাগরে গিয়ে পড়ছে। এতে চরমভাবে দূষিত হয়ে পড়ছে সাগরের পানি, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে অপূরণীয়। এভাবে দূষণের কারণে সাগরের বিভিন্ন অংশে ভেসে আসছে মাছের রেণুসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। আগামী পুরো একমাস সাগরে এসব দূষিত বর্জ্য ফেলা হবে বলে জানা গেছে।

নগরীর বুকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানার মুসলিমাবাদ সাগরপাড় এলাকায় পরিবেশ বিধ্বংসী এমন কাণ্ড সরেজমিনে দেখা গেল মঙ্গলবার (২ ফেব্রুয়ারি)। সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, স্কেভেটরের সাহায্যে একটি জাহাজ থেকে ক্লিংকার বর্জ্য সাগরপাড়ে ফেলা হচ্ছে। একইসঙ্গে সেখানে একটি পুরনো জাহাজও মেরামতের কাজ করা হচ্ছে একই স্থানে। অন্তত ১৫ জন শ্রমিককে সেখানে কর্মরত থাকতে দেখা গেছে।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে গোপনে পতেঙ্গা থানার নদীর চর ও সাগরপাড় এলাকায় অবৈধভাবে জাহাজ কাটাকাটিসহ মেরামত করে আসছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের নিরবতার সুযোগ নিয়ে ওই এলাকায় সাগর ও নদীর পাড়ে ফেলা হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, ডাই, লবণ ও ভারি ধাতু।

পরিবেশ বিধ্বংসী এমন কাণ্ডে আজাদ এন্টারপ্রাইজ নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সরাসরি জড়িত— এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ প্রতিষ্ঠানের দুই অংশীদার হলেন— অমল বাবু ও মাসুদ। প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বন্দরের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, রোববার (৩১ জানুয়ারি) চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ চ্যানেল থেকে ক্লিংকারবাহী জাহাজটি পতেঙ্গায় নিয়ে আসা হয়। জাহাজটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান খায়ের লজিস্টিক। ওইদিন থেকে পতেঙ্গার মুসলিমবাদ সাগরপাড় এলাকায় জাহাজটির ক্লিংকার বর্জ্য পরিস্কার করা হচ্ছে সাগরপাড়ে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, জাহাজ নির্মাণশিল্পে মাধ্যমে এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়। তার ওপর রয়েছে অ্যাসবেসটস মিশ্রিত ধূলা— যা মানুষের শরীরে ঢুকে ফুসফুসের বড় ধরনের ক্ষতি করে। এছাড়া মারাত্মক বিষাক্ত বর্জ্য, বিষাক্ত রাসায়নিক টক্সিনের মতো নানা উপাদান নির্গত হয়ে বিভিন্ন রকমের প্রাণঘাতি রোগ সৃষ্টি হয়।

অন্যদিকে ক্লিংকার বর্জ্য দূষণের কারণে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমার পাশাপাশি বেড়ে যায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড— যা মাছসহ জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য প্রতিকূল।

অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে আজাদ এন্টারপ্রাইজের দুই অংশীদার অমল বাবু ও মাসুদ বলেন, ‘রোববার সন্দ্বীপ থেকে ক্লিংকার জাহাজটি পরিষ্কার করার জন্য আনা হয়েছে। মুসলিমাবাদ সাগরপাড়ে এ বর্জ্য ফেলার কথা ছিল না। বন্দর থেকে জায়গা ব্যবহার করতে অনুমতি নেওয়া হলেও মূলত সিমেন্টের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস অধিদপ্তর কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, ‘বিষয়টি এখন শুনেছি মাত্র। ক্লিংকারের বর্জ্য ফেলার কারণে সাগরের মাছ মরার বিষয়টি খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।’

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের উপপরিচালক নুরউল্লাহ নূরী বলেন, ‘ওই এলাকার ঠিকানা ও অভিযুক্তদের ঠিকানা এসএমএস করুন। আমি এখনই কর্মকর্তা পাঠিয়ে খবর নিচ্ছি। ঘটনার সত্যতা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি পতেঙ্গা বিজয়নগর ঘাট এলাকায় পরিবেশের ক্ষতি করে অবৈধভাবে জাহাজ কাটাকাটি ও মেরামত করার দায়ে চার চক্রকে নোটিশ দিয়ে জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল। অভিযুক্তরা হল এমভি দিদার পরিবহন, এমভি আল সুমনা, এমভি মাছরাঙা এবং অজ্ঞাত কাঠের মাছ ধরার একজন নৌকা মালিক।

এরপর ৩১ জানুয়ারি মুসলিমাবাদ সাগরপাড় এলাকায় জিল্লুর রহমান নামে একজনকেও নোটিশ দিয়ে জরিমানা করা হয়। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তথ্যের ভিত্তিতে এ দুটি অভিযান পরিচালনা করা হয়।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!