পতেঙ্গায় মেয়েদের স্কুলেই ফের প্রধান শিক্ষকের পদে সেই ‘যৌননিপীড়ক’ (ভিডিও)

৫০০ শিক্ষার্থীর ৩৫০ জনই ছাত্রী

স্কুলে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বদলি করা হল চট্টগ্রাম নগরীর কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনকে। তবে তাকে যে স্কুলে বদলি করা হয়েছে, সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত সেই স্কুলটিতেও বালকের পাশাপাশি বালিকারাও পড়াশোনা করে থাকে। এমন অবস্থায় শঙ্কা দেখা দিয়েছে, বালকদের সঙ্গে বালিকারা পড়ে— এমন স্কুলে গিয়েও অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক আবার যৌননিপীড়নের জাল বিস্তার করেন কিনা। নতুন এই বদলির আদেশ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে সমালোচনার ঝড়।

https://youtube.com/shorts/EHNSgI575Cs?feature=share

২০১৩ সালে কাপাসগোলা স্কুলে নিজের বোনের সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করার অভিযোগে প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিনকে তার নিজ রুমেই থাপ্পড় দেন ভুক্তভোগীর ভাই।

রোববার (১ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার স্বাক্ষরিত এক আদেশে অভিযুক্ত শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনকে কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সরিয়ে দক্ষিণ পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে পদায়ন করা হয়েছে। অন্যদিকে হালিশহর আহমদ মিয়া সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রোমা বড়ুয়াকে কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক করা হয়েছে।

দক্ষিণ পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়
দক্ষিণ পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়

জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সুপারিশে বদলি আদেশের ফাইলটি দ্রুত প্রস্তুত করেন প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার। এর পরপরই তাতে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর সম্মতি নেওয়া হয়। মূলত আলাউদ্দিনের বদলির বিষয়টি এই তিনজনই যৌথভাবে সিদ্ধন্ত নেন বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।

জানা গেছে, অভিযুক্ত শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনকে নতুন করে পদায়ন করা দক্ষিণ পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্রদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক ছাত্রীও লেখাপড়া করে থাকে। দক্ষিণ পতেঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ে এবারের ষষ্ঠ শ্রেণির ভর্তির আগে মোট শিক্ষার্থী ছিল ৪৩০ জন। এবার ষষ্ঠ শ্রেণির ভর্তির পর এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০০ জনেরও বেশি। এর মধ্যে অন্তত ৩৫০ জনই ছাত্রী বলে নিশ্চিত করেছেন ওই স্কুলের এক শিক্ষক। তিনি জানান, ৩৫০ শিক্ষার্থী ছাড়াও দুজন মহিলা শিক্ষক রয়েছেন এই স্কুলে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই শিক্ষক ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘সব বিষয় জানার পরও আলাউদ্দিনের মত একজন শিক্ষককে দক্ষিণ পতেঙ্গা স্কুলে বদলি করা খুব দুঃখজনক। আমরা আগে থেকে জানি ওনার চরিত্র সম্পর্কে। ওনার মত একজন শিক্ষককে স্থায়ী বহিষ্কার না করে কেন শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে এখানে পাঠালো বিষয়টি বুঝতেছি না। এমনকি এই স্কুলে মেয়ে শিক্ষার্থী বেশি, এখন এদের দায়ভার কে নেবে?’

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সচিব খালেদ মাহমুদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘দক্ষিণ পতেঙ্গা স্কুলে মেয়েরাও পড়ে? এটা তো জানতাম না। অবশ্য আমি এই বিষয়ে জানি না কিছু। এটার বিষয়ে আমাদের শিক্ষা কর্মকর্তা জানবেন। বিষয়টি ওনার এখতিয়ারে।’

এদিকে কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সদ্যবিদায়ী প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তাকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

চসিক সচিব খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘এবার তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পেলে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হবে।’

স্কুলের ছাত্রীদের নিজ রুমে ডেকে বিশেষ ক্লাস, মধ্যরাতে অশালীন ম্যাসেজ ও কল, ম্যাসেঞ্জারে অশ্লীল ইঙ্গিত এমনকি মেয়ের বয়সী ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনসহ আরও নানান অভিযোগের তীরে বিদ্ধ কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন।

গত ১০ বছরে অন্তত অর্ধডজনবার মেয়েঘটিত বিষয়ে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে উঠেছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। সর্বশেষ রোববার (১ জানুয়ারি) নিজ স্কুলের ছাত্রীদের থেকে জুতোপেটা হয়ে শেষমেশ বদলি হন নগরীর ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে।

প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তি ছাড়াও যৌন হয়রানির অভিযোগে ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকেও একাধিকবার শাস্তি এমনকি চড়থাপ্পড় খাওয়ার মতো স্মৃতি আছে এই শিক্ষকের জীবনে। ২০১৩ সালে কাপাসগোলা স্কুলে নিজের বোনের সঙ্গে অশ্লীল আচরণ করার অভিযোগে নিজ রুমেই থাপ্পড় দেন ভুক্তভোগীর ভাই। ছাত্রীর বড় ভাইয়ের কাছ থেকে মার খাওয়ার সেই ভিডিওটি হাতে এসেছে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে। ওই সময়ও ছাত্রীর বড় ভাইয়ের পা ধরে ক্ষমা চান প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন এবং পরবর্তীতে এরকম আর হবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

এর আগে ২০১৩ সালের ১১ জুলাই ছবি সত্যায়িত করতে গেলে দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করেন প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন। একই দিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে ওই ছাত্রীর মোবাইলে ফোন করেও তিনি উত্যক্ত করেন ওই ছাত্রীকে। বিষয়টি নিয়ে ওই সময়কার মেয়র মনজুর আলমকে লিখিত অভিযোগ দেন ওই ছাত্রী। মেয়রের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ওই বছরের ১৫ ও ১৬ জুলাই এলাকাবাসী প্রধান শিক্ষকের অফিস ঘেরাও করে। এর একপর্যায়ে ছাত্রীটি ও তার অভিভাবকের কাছে ক্ষমা চান আলাউদ্দিন।

পরে এই ঘটনায় বহিষ্কার হন প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় বিভাগীয় মামলাও। তবে অভিযোগকারী ছাত্রী বিদেশে চলে গেলে সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে বহিষ্কারের ৫ বছর পর ২০১৮ সালে ফের চাকরি ফিরে পান আলাউদ্দিন। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা সুমন বড়ুয়া ‘বন্ধু’ হওয়ায় চাকরি ফিরে পেতে সমস্যা হয়নি অভিযুক্ত শিক্ষক আলাউদ্দিনকে। এমনকি এরপরও বহুবার যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলেও সুমন বড়ুয়ার হস্তক্ষেপে প্রতিবারই রেহাই পেয়ে যান আলাউদ্দিন।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে ফের চাকরি ফিরে পাওয়ার পর আলাউদ্দিনকে ছালেহ জহুর সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। ওই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক থাকা অবস্থায়ও নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে তিনি যৌন নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় অভিভাবক ও এলাকাবাসী তাকে প্রায় ২ ঘন্টা অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে ওই শিক্ষার্থী ও তার মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেন তিনি। ওই বছরই পুলিশ লাইন উচ্চ বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে থাকাবস্থায়ও একাধিক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে।

এরপর কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বদলি হয়ে আসেন আলাউদ্দিন। ২০১৯ সালে ওই স্কুলের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ উঠে প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, ভুক্তভোগী ছাত্রীর সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কথোপকথন শুরু করেন প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন। শিক্ষক আলাউদ্দিন ওই ছাত্রীকে স্কুলে গেলে বারবার তার কক্ষে যাওয়ার প্রস্তাব দিতেন। পরবর্তীতে জিইসি মোড়ের এক কোচিং ক্লাসে ওই ছাত্রীকে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ভুক্তভোগী ছাত্রী সেখানে একা গেলে সেখানে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হলে কোনোমতে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে ওই ছাত্রী। এছাড়াও নানা অশালীন বার্তাও ছাত্রীকে মেসেঞ্জারে পাঠাতেন প্রধান শিক্ষক।

এই ঘটনায় ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর একজন অভিভাবক চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে একটি অভিযোগ জমা দেন। কিন্তু ওই সময়ে সিটি করপোরেশনের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা ছিলেন আলাউদ্দিনেরই সহপাঠী সুমন বড়ুয়া। ফলে তদন্ত নিয়ে তখনই প্রশ্ন উঠে। পরবর্তীতে অভিযোগ থেকে যথারীতি দায়মুক্তি পেয়ে যান তিনি।

এমন এক অভিযুক্ত শিক্ষককে ৫ বছর পর ফের মেয়েদের বিশেষায়িত স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পুনঃপদায়ন করা হয়। অভিযোগ প্রমাণের পর বহিষ্কৃত কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী ফের চাকরি ফিরে পেতে পারেন না— এমনই বিধিমালা আছে সিটি কর্পোরেশনের। এরপরও কিভাবে এই আলাউদ্দিন চাকরি ফিরে পেলেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সচিব খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘তখন যারা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বে ছিলেন তারা কোন্ বিচারে কোন্ আইনে তাকে ৫ বছর পর চাকরি ফিরিয়ে দিয়েছে সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না। এখানে নিশ্চয় কোনো কিন্তু আছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!