পণ্য সরবরাহে চট্টগ্রাম বন্দরে এমন ধস!

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য সরবরাহে ধস নেমেছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরির শঙ্কা জানাচ্ছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। ২৬ মার্চ থেকে সরকারঘোষিত সাধারণ ছুটি কার্যকরের পর থেকে গত পাঁচ দিনে ৭২ শতাংশ কমেছে পণ্য সরবরাহ।

চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়ছে। জাহাজ থেকে পণ্য উঠানামাও হচ্ছে স্বাভাবিক গতিতে। কিন্তু বন্দর ইয়ার্ড থেকে সেই পণ্য সরবরাহ হচ্ছে না। এতে রমজানের ভোগ্যপণ্য, জরুরি পণ্য এবং শিল্প কারখানার আমদানি পণ্য বন্দর ইয়ার্ডে আটকা পড়েছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দিনে চার থেকে সাড়ে চার হাজার একক পণ্যভর্তি কন্টেইনার ডেলিভারি নেন আমদানিকারকরা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সেই ডেলিভারি কমেছে তিন হাজারে। কিন্তু ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি শুরুর পর ডেলিভারি কমে গড়ে সাড়ে ১২০০ একক কন্টেইনারে নেমেছে। অর্থাৎ ডেলিভারি কমেছে ৭২ শতাংশ। আর পণ্য সরবরাহে ধস নামায় কন্টেইনার রাখার স্থান কমে গিয়ে পরিচালন ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটছে।

বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, সাধারণ ছুটির পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ওঠানামায় শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে দুদিন কাজ বন্ধ ছিল। সেই কর্মঘণ্টা ছাড়া বন্দরের কাজ পুরোপুরি স্বাভাবিক ছিল আর পণ্য ডেলিভারিতে চট্টগ্রাম বন্দর সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। ছুটির দিনে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক খোলা রেখেছে দিনে দুই ঘণ্টা। শিপিং এজেন্টও অফিস খোলা রেখে দুই ঘণ্টা কার্যক্রম চালাচ্ছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসও সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চালাচ্ছে। মহাসড়কে পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলে কোনো বাধা নেই। ভোগ্যপণ্যের বড় আড়তগুলো খোলা আছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাবে, সাধারণ ছুটি শুরুর আগের দিন ৪ হাজার ৯১১ একক কন্টেইনার বন্দর থেকে ডেলিভারি হয়েছিল। পরদিন ২৭ মার্চ ডেলিভারি হয়েছিল ১৪শ ২৩ একক, ২৮ মার্চ ৯০৬ একক, ২৯ মার্চ ১২শ ৮৬ একক, ৩০ মার্চ ডেলিভারি হয়েছে ১৩শ ৯৩ একক কন্টেইনার। মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) পর্যন্ত বন্দরে কন্টেইনার জমেছিল প্রায় ৪১ হাজার একক; অথচ বন্দরের কন্টেইনার রাখার মোট ধারণক্ষমতা হচ্ছে ৪৯ হাজার একক।

কনটেইনার ডেলিভারি কমেছে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক ট্রাফিক এনামুল করীম বলেন, ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য ২৪ ঘন্টা চালু রাখা হয়েছে বন্দরের কার্যক্রম। ব্যবসায়ীরা কেন ডেলিভারি নিচ্ছেন না সেটি আমার বুঝে আসছে না।

চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, সাধারণ ছুটিতে শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ থাকায় বন্দর থেকে আমদানি পণ্য নেওয়া কমে গেছে। আড়তগুলো চালু থাকলেও বেচাকেনা সীমিত হয়ে গেছে। কিন্তু এই অবস্থা চলতে থাকলে তো চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ হয়ে যাবে।

চেম্বার সভাপতি বলেন, সারা দেশে কোনোভাবে যাতে পণ্য সরবরাহ ব্যাঘাত না হয় এবং কেউ যাতে অনৈতিক ফায়দা লুটতে না পারে সেজন্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন সচল রাখতে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে ডেলিভারি বাড়বে। একই সাথে ফল ও খাদ্যপণ্য ছাড় করতে বিশেষ ব্যবস্থায় উদ্ভিদ সংগনিরোধ দপ্তর ও আণবিক শক্তি কমিশনের অফিস খোলা রাখার অনুরোধ জানাই। একই সাথে সারা দেশে দোকানপাট বন্ধ থাকায় পণ্য বাজারেও বেচাকেনা কমে গেছে। ফলে ছুটির মধ্যে অনেকেই বন্দর থেকে পণ্য সরবরাহ নিচ্ছে না।

ডেলিভারি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে চেম্বার সভাপতি বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক দুই ঘণ্টা খোলা রেখে যে ব্যাংকিং করছে তাতে এত পণ্য ডেলিভারি অর্ডারের কাজ করা যাচ্ছে না। আর কাস্টমসও নির্ধারিত কিছু পণ্য শুল্কায়নের জন্য কাজ করছে। এই নিয়মের কারণেও বন্দর থেকে পণ্য ছাড়ে আগ্রহ কমেছে। অবশ্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সীমিত পরিসরে সব পণ্য শুল্কায়নের জন্য নতুন নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু সেটি কার্যকর হলেও তো লোকবল সংকট রয়েছে।

টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের চিফ অপারেটিং অফিসার ক্যাপ্টেন তানভীর হোসাইন জানান, কন্টেইনার ওঠানামার ৬০ শতাংশ ওঠা-নামা হয়ে থাকে চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি টার্মিনাল এনসিটি ও সিসিটিতে। সাধারণ ছুটির মধ্যে কাজ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে শ্রমিকদের নিজ বাসা থেকে বন্দরে আনা-নেওয়া করতে তিনটি বিশেষ বাস সার্ভিস চালু করেছে টার্মিনাল অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক। একই সাথে শ্রমিকদের করোনা ঝুঁকি এড়াতে বিশেষ নিরাপত্তা মাস্ক, ২০টি পয়েন্টে সাবান-স্যানিটাইজারও ব্যবস্থা করেছে। ফলে এই দুটি টার্মিনালে পণ্য ওঠানামা নিরবিচ্ছন্ন রয়েছে।

ক্যাপ্টেন তানভীর বলেন, ‘রপ্তানি কমে যাওয়ায় এখন ২৪ ঘণ্টায় আমরা জাহাজে ৪২শ একক কন্টেইনার ওঠানামা করছি। কিন্তু সে অনুযায়ী কন্টেইনার বন্দর থেকে বের হচ্ছে না। ফলে জাহাজ থেকে নামিয়ে কন্টেইনার রাখার ইয়ার্ড সংকট তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এহসানুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, আর কয়েক দিন কনটেইনার ডেলিভারি না হলে পুরো বাংলাদেশ অচল হয়ে যাবে। বন্দরের ইয়ার্ডেও জায়গা থাকবে না কনটেইনার রাখার। তখন জাহাজ দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে। এতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতির মাশুল গুণতে হবে।

এএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!