চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমসে জালিয়াতির জাল, ফাঁসছেন ৩২ কর্মকর্তা

৭ সিএন্ডএফের সঙ্গে চিহ্নিত ১৪ আমদানিকারকও

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সার্ভারে ঢুকে ‘লক’ করা ২২টি চালানের ২৭ কন্টেইনার পণ্য জালিয়াতির মাধ্যমে খালাস করার ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের ৩২ কর্মকর্তা, ১৪ আমদানিকারক ও ৭ সিএন্ডএফ এজেন্ট। জালিয়াতির এ ঘটনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) এবং চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ আলাদা আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করে।

পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে জালিয়াতির এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও তার সাথে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

ঘটনার শুরু
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে একটি সিন্ডিকেট ঘোষণাবর্হিভূত পণ্য আমদানি করছে—এমন খবরে ২২ কনসাইনমেন্টের (চালান) ২৭ কন্টেইনার পণ্য খালাস না করার জন্য চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজকে চিঠি দেয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এরপর ওই সংস্থা থেকে ২৭ কন্টেইনার পণ্যের শতভাগ কায়িক পরীক্ষাও করা হয়। পরীক্ষার পর ওই কনসাইনমেন্টগুলো যাতে খালাস না দেওয়া হয় তা এনবিআর সার্ভার অ্যাসাইকুডায় লক (খালাস বন্ধ) করা হয়। তাদের দেওয়া সিদ্ধান্তের পরও ওই ২৭ কন্টেইনার পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস হয়ে যায়।

জালিয়াতি হয় যেভাবে
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ থেকে পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত অ্যাসাইকুডা সফটওয়্যার সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে কর্মরত প্রত্যেক কর্মকর্তার নামে দেওয়া হয় আলাদা আলাদা ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড। আইডির পাসওয়ার্ড শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারই জানা থাকে। কোনো কর্মকর্তা অবসরে গেলে সেই আইডি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পণ্যগুলো খালাসে দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা আশ্রয় নেয় জালিয়াতির। অবসরে যাওয়া রাজস্ব কর্মকর্তা ডিএএম মহিবুল ইসলাম সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ফজলুল হকের ইউজার আইডি ব্যবহার করে এসব কন্টেইনার খালাস করে জালিয়াতচক্র।

জালিয়াতির ঘটনায় চিহ্নিত ১৫ কাস্টমস কর্মকর্তা
অবসরে যাওয়া দুই কর্মকর্তার ইউজার আইডি ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে লক করা কনসাইনমেন্ট খালাস করার এই ঘটনায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের ১৫ কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ওই প্রতিবেদনে। ওই কর্মকর্তারা হলেন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের সিস্টেম অ্যানালিস্ট গোলাম সরোয়ার (বর্তমানে এনবিআরে কর্মরত), ডেপুটি কমিশনার শাহিনুর রহমান পাভেল (সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে বদলি), রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ, শহিদুল ইসলাম, নুরে আলম, হাবিবুল ইসলাম, মনোয়ার হোসেন চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, মেহেরাব আলী, এস এম মোশারফ হোসেন, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা এ এইচ এম নজরুল ইসলাম, শাহরিয়ার হোসেন, মোহাম্মদ নূর ই আলম, সাইফুন্নাহার জনি, মির্জা সাইদ হাসান ফরমান। রাজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে সম্প্রতি এনবিআর থেকে বদলির আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন।

জালিয়াতিতে চিহ্নিত বন্দরের ১৭ কমকর্তা-কর্মচারী
জালিয়াতির ঘটনায় চিহ্নিত বন্দরের কমকর্তা-কর্মচারীরা হলেন উচ্চমান বহিঃসহকারী শাহাবুদ্দিন, সানোয়ার মিয়া, মফিজুর রহমান হেলেন, শেখ বাচ্চু মিয়া, ইলিয়াস, হামিদুর রহমান, নাজিম উদ্দীন, কবির আহম্মেদ, শ্যামল কৃষ্ণ ভৌমিক, সালাউদ্দিন পায়েল, মোরশেদুল হাসান, ওমর ফারুক, অর্পণ কান্তি দেবনাথ, মাইনুদ্দীন, অনিক, আব্দুল গনি এবং মোস্তাফিজুর রহমান।

জালিয়াতিতে জড়িত ৭ সিএন্ডএফ এজেন্ট
সংঘবদ্ধ জালিয়াতির ঘটনায় চিহ্নিত করা হয়েছে চট্টগ্রামে কর্মরত ৭ সিএন্ডএফ এজেন্টকে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো স্মরণিকা শিপিং কাইজেন লিমিটেড, এমঅ্যান্ডকে ট্রেডিং করপোরেশন, চাকলাদার সার্ভিস, এম আর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, লায়লা ট্রেডিং কোম্পানি, লাবনী এন্টারপ্রাইজ এবং মজুমদার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।

চিহ্নিত ১৪ আমদানিকারক
জালিয়াতির এই ঘটনায় যেসব আমদানিকারককে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হলো এসএএম ইন্টারন্যাশনাল, খান এন্টারপ্রাইজ, এম এস সুপার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জারার এন্টারপ্রাইজ, আর কে ইন্টারন্যাশনাল, সিফাত ট্রেডিং, এইচএল ট্রেডিং করপোরেশন, মিমি লেদার কটেজ, এ কিউ ট্রেডিং, এমএস জাহিদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এস পি ইন্টারন্যাশনাল, এসকেএস এন্টারপ্রাইজ, এমডি ওয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল, মুভিং ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।

জালিয়াতির ঘটনায় চার তদন্ত কমিটি
জালিয়াতির এই ঘটনায় চারটি প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা আলাদা চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষ থেকে কমিটির প্রধান কমিশনার (আপিল) ফখরুল আলম (বর্তমানে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার), শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর কমিটির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুল হাকিম, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) কমিটির প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিচালক খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেন এবং চট্টগ্রাম কাস্টমস গঠিত কমিটির প্রধান যুগ্ম কমিশনার এইচ এম শরিফুল হাসান। এছাড়াও পুলিশের সিআইডি ঘটনার তদন্ত করছে।

সফটওয়্যারে অনুপ্রবেশ জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সার্ভারে অনুপ্রবেশ করে অবৈধভাবে পণ্য খালাস করা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহল মিথ্যা ঘোষণায় বৈধ পণ্য আমদানির আড়ালে অবৈধ পণ্য (অস্ত্র/বিস্ফোরক/গোলাবারুদ) দেশে প্রবেশ করাতে পারে মর্মে প্রতীয়মান। এ ছাড়াও সার্ভার হ্যাকিংয়ের ঘটনায় দেশের মর্যাদাও ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং বন্দরের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এতে অসাধু আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত।

ডিসি পাভেল, আরও সুলতানের বিরুদ্ধে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ থেকে সম্প্রতি বদলি হওয়া ডিসি (ডেপুটি কমিশনার) শাহিনুর রহমান পাভেল এবং রাজস্ব কর্মকর্তা সুলাতান আহমেদকে জালিয়াতির এই ঘটনায় চিহ্নিত করার পাশাপাশি আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের সাথে অবৈধ লেনদেনে জড়িত থাকার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৭টি কনটেইনারের চালানগুলো ছাড়াও বিভিন্ন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের কাছ থেকে কাস্টমসের ডিসি শাহিনুর রহমান পাভেল ও রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ অবৈধ অর্থের বিনিময়ে প্রচুর পরিমাণ আমদানিকৃত পণ্য খালাসে সহযোগিতা করেছে। এ ঘটনায় জড়িত সিএন্ডএফ এজেন্টদের আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এ সংক্রান্ত আরো তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

তদন্ত কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই প্রতিবেদনে গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার শংকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয় পণ্য পাচারের ঘটনায় জড়িত কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এবং তদন্তে নিয়োজিত কাস্টমস কর্মকর্তারা একজন আরেকজনের পরিচিত। কাজেই এই তদন্ত কমিটি দিয়ে সঠিকভাবে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার বিষয় নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। এ ছাড়াও জালিয়াতি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তথ্যানুসন্ধানে প্রাপ্ত ব্যক্তিরা কাস্টমস হাউজে অদ্যাবধি কর্মরত। ফলে তদন্ত কার্যক্রম ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জালিয়াতির ঘটনায় শাস্তির যতো সুপারিশ
তদন্ত প্রতিবেদনে শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, সুপারিশগুলো ঘটনার বিষয়ে দ্রুত তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে, তদন্তে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে প্রতিবেদনে উল্লিখিত ব্যক্তিদের অন্যত্র বদলির ব্যবস্থা করা, ২২টি চালান ছাড়ের ঘটনায় সম্পৃক্ত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা, এনবিআর সার্ভারের (অ্যাসাইকুডা) সফটওয়্যারের সঙ্গে সম্পৃক্ত এনবিআরের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরে গেলে কিংবা অন্যত্র বদলি হলে তাৎক্ষণিক তাদের ব্যবহৃত ইউজার আইডি স্থায়ীভাবে বন্ধ করা জরুরি। দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চট্টগ্রাম বন্দরের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব নেয়া এবং সেই সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করা।

এসসি/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!