চট্টগ্রামের ১০/ নৌকার বিদ্রোহীদের কৌশলে শাস্তি দিতে চায় আওয়ামী লীগ

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। তবে যতোটা দ্রুতগতিতে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ভাবা হয়েছিল, সেরকম কিছু হয়নি। বরং শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়াটিই প্রায় ঝুলে গেছে।

এর নেপথ্য কারণ হিসেবে দলীয় সূত্রগুলো জানাচ্ছে শুরুতে কঠোর মনোভাব থাকলেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অনেক বিদ্রোহী প্রার্থীর প্রতিই নমনীয় মনোভাব পোষণ করছেন। তারা মনে করছেন, বিদ্রোহী প্রার্থীদের অনেকেই দলের দুঃসময়ে অবদান রেখেছেন। কিন্তু ভুল তথ্যের কারণে মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সম্পর্কে ঢালাওভাবে যেসব অভিযোগ এসেছে, তার সত্যতাও সেভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়নি। মূলত এসব কারণে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আপাত শক্ত অবস্থান থেকে কিছুটা নমনীয় অবস্থানে সরে এসেছে।

তবে দলীয় সূত্রের দাবি, সব বিদ্রোহীর প্রতিই নমনীয় হবে না আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব৤ যাদের বিরুদ্ধে দলপরিপন্থী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ সুস্পষ্ট, তাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানেই থাকবে সরকারি দল৤ ২০ জুলাইয়ের পর ধাপে ধাপে এসব বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে বহিষ্কারাদেশের চিঠি পাঠানোর কথা থাকলেও সব বিদ্রোহীই সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে কারণ দর্শাওয়ের চিঠি হাতে পেতে শুরু করবেন বলে জানা গেছে। সেপ্টেম্বরে দলের পরবর্তী কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক থেকে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ঘোষণা আসতে পারে।

দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, বোয়ালখালী, লোহাগাড়া ও বাঁশখালী উপজেলা এবং কক্সবাজার সদর উপজেলা, টেকনাফ, রামু, মহেশখালী ও চকরিয়া উপজেলার মোট ১০ জন আওয়ামী লীগ নেতা শাস্তির মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন।

এর বাইরে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থক যারা, তাদের বিরুদ্ধেও নেওয়া হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। দলীয় বিভিন্ন পদে দায়িত্বরত থেকে যারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থন দিয়েছেন, কৌশলে তাদের দলীয় পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। দলের স্থানীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি কমিটিতে এদের রাখা হবে না। এছাড়া সাংগঠনিকভাবে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার জন্য পরোক্ষ কৌশল অবলম্বন করা হবে।

বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থন দেওয়া মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কঠোর অবস্থান নেওয়ার পক্ষপাতি। সাংগঠনিকভাবে তাদের সক্রিয় রাখা হলেও ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচনে তাদের মনোনয়ন না দেওয়ারও একটি সিদ্ধান্ত হতে পারে।

চট্টগ্রামে শাস্তির মুখোমুখি হতে যাওয়া নেতারা
চট্টগ্রামে দলীয় পদে থাকার পরও সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করায় শাস্তির মুখোমুখি হতে যাওয়া নেতারা হলেন চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান হুসেইন মোহাম্মদ আবু তৈয়ব, লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান জিয়াউল হক চৌধুরী বাবুল। বাঁশখালী উপজেলায় দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি ও শ্রমবিষয়ক সম্পাদক মো. খোরশেদ আলম। বোয়ালখালীতে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল কাদের সুজন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের এডহক কমিটির সহ সভাপতি শ্রমিক নেতা এসএম নুরুল ইসলাম।

এছাড়া আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় কোনও পদে না থাকলেও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করেছেন পটিয়ায় সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ও বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি মুহাম্মদ সাজ্জাত হোসেন। চন্দনাইশে এলডিপি থেকে এসে আওয়ামী লীগে ফুল দিয়ে যোগ দিলেও আনুষ্ঠানিক কোনো পদে না থাকা নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল জব্বার।

অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচিত হলেও কোনও পদে নেই উপজেলা নির্বাচনের বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নুর হোসেন। তবে তাদের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত না হলেও সরকারদলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে তাদেরও শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে বলে ধারণা করছেন নেতারা।

কক্সবাজারে শাস্তির মুখোমুখি হতে যাওয়া নেতারা
দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে কক্সবাজার সদর উপজেলা, টেকনাফ, রামু, মহেশখালী ও চকরিয়া উপজেলার পাঁচ আওয়ামী লীগ নেতা শাস্তির মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। এর মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন রামুতে সোহেল সরওয়ার কাজল, মহেশখালীতে শরীফ বাদশা এবং চকরিয়ায় ফজলুল করিম সাঈদী।

শাস্তির মুখোমুখি হতে যাওয়া নেতারা হলেন কক্সবাজার সদর উপজেলায় জেলা আওয়ামী লীগ সদস্য নুরুল আবছার, টেকনাফে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাফর আলম, রামুতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজল, মহেশখালীতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শরীফ বাদশা এবং চকরিয়ায় উপজেলা আওয়ামী লীগ সহসভাপতি ফজলুল করিম সাঈদী।

কক্সবাজার সদর উপজেলায় বিদ্রোহী প্রার্থী নুরুল আবছার নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক কায়সারুল হক জুয়েলের কাছে হেরে যান তৃতীয় স্থান নিয়ে। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃতীয় স্থান পান। তবে সেখানে নির্বাচিত হয়েছেন আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নুরুল আলম।

অন্যদিকে রামু উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও রামু উপজেলা যুবলীগ সভাপতি রিয়াজুল আলমকে হারিয়ে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সোহেল সরওয়ার কাজল। মহেশখালী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী মোহাম্মদ হোছাইন ইব্রাহিমকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন বড় মহেশখালী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শরীফ বাদশা। চকরিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফজলুল করিম সাঈদী। তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীকে পরাজিত করেন।

সিদ্ধান্ত এসেছে যেভাবে
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৮ বিভাগে আওয়ামী লীগের অভিযুক্ত দুই শতাধিক নেতার মধ্যে রয়েছেন—ঢাকায় সর্বোচ্চ ৪৫ জন এবং চট্টগ্রামে রয়েছেন ১৭ জনেরও বেশি। এছাড়া বিদ্রোহীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার অপরাধে সারা দেশে ৬২ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে।

শুধু আওয়ামী লীগের নয়, সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যেসব নেতা উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে কেন তাদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না—তা জানতে চেয়ে পাঠানো হবে কারণ দর্শানোর নোটিশ।

গত ৫ এপ্রিল দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, যারা উপজেলা নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরোধিতা করেছেন, বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিদ্ধান্ত হয়, যেসব এমপি-মন্ত্রী নৌকার বিরোধিতা করেছেন বা করবেন, তাদের আগামীতে আর নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হবে না।

এরপর গত ১২ জুলাই সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় এসব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দলে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতেই মূলত এই কঠোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। এছাড়া নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে গিয়ে যেসব মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী নেতারা কাজ করেছেন, তাদেরও কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। দর্শানো কারণের জবাব যথার্থ না হলে প্রাথমিক সদস্যপদসহ দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কার হতে পারেন অভিযুক্তরা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!