‘নেতা-পুলিশের প্রশ্রয়ে’ গাড়ির স্টেশন বসিয়ে পথে পথে চাঁদাবাজি

নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো যত্রতত্র বসানো হয়েছে সিএনজি অটোরিকশার স্পট। প্রতিটি স্পটে সিএনজি অটোরিকশা থেকে নেয়া হচ্ছে দৈনিকভিত্তিতে চাঁদা। সাত স্পটের পাশাপাশি শহরের প্রধান সড়কে চলমান সিএনজি অটোরিকশা থেকেও আদায় করা হয় চাঁদা। এভাবে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করে পর্যটন নগরী কক্সবাজার শহরে মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। এই চাঁদাবাজির একটি অংশ পৌরসভার ইজারাদারের পকেটে গেলেও বাকি অংশ যাচ্ছে সিএনজি অটোরিকশা সমিতি ও শ্রমিক নেতাসহ চাঁদা আদায়ে জড়িতদের পকেটে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শহরের লালদীঘি প্যানোয়া রোড, স্টেডিয়াম মার্কেট, কোর্ট বিল্ডিং, বাজারঘাটা, খুরুশকুল রোডের মাথা, কলাতলী বাসটার্মিনাল স্টেশনগুলোর মধ্যে বাজারঘাটা ও টার্মিনাল ছাড়া বাকিগুলো অবৈধ স্টেশন বা পার্কিং বলে দাবি স্থানীয়দের। মূলত চাঁদা আদায়কারিরা নিজেদের পকেট ভারি করার জন্য যে যার মতো স্টেশন বসিয়ে চাঁদাবাজি করছে। বেপরোয়া এই চাঁদাবাজদের কারণে প্রতিনিয়ত শহরের বিভিন্ন স্থানে লেগে থাকে যানজট। পাশাপাশি আর্থিক হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ চালকরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চাঁদা আদায়কারী জানান, ‘পৌরসভার ১৫ টাকার রশিদে ৭টি স্পটের পাশাপাশি প্রধান সড়ক থেকে প্রতি সিএনজি অটোরিকশা থেকে আদায় করা হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এরমধ্যে পৌরসভার ইজারাদার পায় ১৫ টাকা, সমিতি নেয় ১০-১৫ টাকা, মাসিক হিসেবে ট্রাফিক পুলিশের পকেটে যায় একটি অংশ। বাকি টাকা চাঁদা আদায়ে জড়িতরা নেয়।’ তবে সমিতি থেকে প্রতি মাসে এক শ্রমিক নেতাকেও মাসোহারা দিতে হয় বলে জানান তিনি।

শহরের লালদীঘির প্যানোয়া রোডের অবৈধ স্টেশনে প্রতিদিন অসংখ্য সিএনজি অটোরিকশা অবস্থান নেয়। এসব গাড়ির গন্তব্য টেকনাফ বা শাপলাপুর ইউনিয়ন। এই অবৈধ স্টেশনে পার্কিং করা গাড়ির চালকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই স্টেশনে দৈনিক ৫০-৬০টি গাড়ি অবস্থান নেয়। প্রতি গাড়ি থেকে দৈনিক ৫০ টাকা আদায় করা হয়। আর এসব টাকা আদায় করে জলিল নামের একজন।

জলিল জানান, ‘দৈনিক প্রতি সিএনজি থেকে ৪৫ টাকা নেওয়া হয়। অনেকে খুশি হয়ে ৫০ টাকাও দেয়। এই টাকার মধ্যে ১৫ টাকা নেয় সে নিজেই, ১৫ টাকা পৌরসভার পার্কিং ফি, ১০ টাকা সমিতি, বাকি টাকা মসজিদ ও ট্রাফিকের জন্য। আর প্রতি মাসে শ্রমিক লীগের এক শীর্ষ নেতাকে মাসোহারা দেয় সমিতি।’

একইভাবে শহরের স্টেডিয়াম সড়কের পাশে দৈনিক দেড়শর বেশি সিএনজি অটোরিকশা পার্কিং হয় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

তবে চাঁদা আদায়কারি যুবক কবিরের দাবি প্রতি সিএনজি অটোরিকশা থেকে দৈনিক ৩০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। ১৫ টাকা ইজারাদার ও ১৫ টাকা কবিরের। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ৪০ টাকার উর্ধ্বে টাকা আদায় করে কবির এমনটাই জানিয়েছে অনেকে।

এদিকে, উল্লেখিত দুই স্টেশনে চাঁদা আদায় ও ভাগবাটোয়ার হিসেব থাকলেও শহরের কোর্ট বিল্ডিং চত্বরে চাঁদা আদায়কারি মো. করিমের কোনও হিসেব নেই। সে শুধু প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের নাম ব্যবহার করে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে। প্রতি গাড়ি থেকে নেয় ৫০ টাকা। হিসেব দিতে হয়না ইজারাদার কিংবা অন্য কাউকে। তবে যুবদল ত্যাগ করে সদ্য শ্রমিকলীগে যোগদান করা এক এক নেতাকে ভাগ দিতে হয় বলে জানান করিম। ওই নেতাকে সম্প্রতি একটি সংস্থা ধরে নিয়ে গিয়ে রাম ধোলাই দেয়ার ঘটনাও রয়েছে। তারপরও ধান্ধবাজি চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়াও খুরুশকুল রোডের মাথা, বাজারঘাটা, কলাতলী ও বাসটার্মিনালেও চলছে চাঁদাবাজি। ইজারার ইস্যুতে প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে একাধিক স্টেশন বসিয়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজির ব্যাপারে কক্সবাজার সদরের ভারুয়াখালী ইউনিয়নের শহিদুল্লাহ মেম্বার বলেন, আমরা কয়েকজন মিলে পৌরসভার পার্কিং ইজারা নিয়েছি। তবে স্টেশন বসায়নি। তাছাড়া প্রধান সড়ক থেকে গাড়ি থামিয়ে টাকা আদায়ে কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। যারা টাকা আদায় করছে তারা যদি ১৫ টাকার বেশি আদায় করে ওই চাঁদাবাজির দায়দায়িত্ব আমরা নিবো না। এছাড়া কোর্ট বিল্ডিংয়ে যে স্টেশন বসানো হয়েছে তাতে পৌরসভার কোন ইজারা আদায় করা হয় না। এটি সম্পূর্ণ অনৈতিক বলে দাবি করেন ইজারাদার শহিদুল্লাহ।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাহী সদস্য ও জেলা ক্রিকেট কোচ আশরাফুল আজিজ সুজন বলেন, ‘স্টেডিয়ামের সামনে স্টেশন বসানোর কারণে খেলোয়াড়সহ সর্বস্তরের মানুষের ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে সিএনজি গাড়িগুলো রাস্তা দখল করে দাড়িয়ে থাকার কারণে প্রায়ই যানজট লেগে থেকে।’

তিনি বলেন, ‘সামনে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। তারা টিফিন ছুটিতে বের হতে পারেনা। সিএনজি অটোরিকশা চালকরা সমস্যা করে। তাই দ্রুত এসব অবৈধ সিএনজি স্টেশন উচ্ছেদ করে চাঁদাবাজি বন্ধ করাসহ সড়ক উন্মোক্ত রাখার আহবান জানাচ্ছি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ (টিআই) আমজাদ হোসেন বলেন, ‘জেলায় আমরা নতুন এসেছি। এখনও সবগুলো স্পট চিনি না। তবে ট্রাফিক বিভাগে কোন প্রকার মাসিক মাসোহারা নেওয়া হয়না। তাছাড়া চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি ট্রাফিকের নাম ব্যবহার করে কেউ চাঁদাবাজি করে সিনিয়র অফিসারের সাথে কথা বলে তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এসএ/এমএহক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!