নেতার প্রশ্রয়ে চট্টগ্রামজুড়ে অনুপ বিশ্বাসের বেপরোয়া মদব্যবসা

মদের বৈধ লাইসেন্সের অবৈধ কারবার

মাঝে মাঝে অভিযান চলে, চুনোপুটিরা হয় গ্রেপ্তার, সাজাও পায় তারাই। কিন্তু চোলাইমদের যে অবৈধ ব্যবসা এখন চট্টগ্রামজুড়ে ছেয়ে গেছে, তার মূল হোতার নাগাল কখনোই পাওয়া যায় না। তিনি থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। চট্টগ্রামের প্রভাবশালীরা তাকে ছায়া দিয়ে যান অর্থের বিনিময়ে। তিনি অনুপ বিশ্বাস—কখনও জাতীয় পার্টি, কখনও আওয়ামী লীগ। কখনও সংস্কৃতিসেবী, কখনও ক্রীড়া সংগঠক। দশকের পর দশক তার নেতৃত্বে চট্টগ্রামজুড়ে চলছে চোলাই মদের ব্যবসা।

সোমবার (২৬ আগস্ট) মধ্যরাতে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন ফিশারিঘাট এলাকায় অভিযান চালিয়ে অনুপ বিশ্বাসের মদের মহাল থেকে ৩০ হাজার লিটার মদ জব্দ করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব)। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত এই অভিযানে আটক করা হয় ৪৫ জন মাদকসেবীকে। কিন্তু এ নিয়ে হয়নি কোনো মামলা।

জানা গেছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ২৯ জনকে চারদিনের জেল ও ৪০০ টাকা জরিমানার সাজা দেওয়া হয়েছে। ছেড়ে দেওয়া ১৬ জনের মধ্যে পাঁচজন ছিল পথচারী। আর বাকি ১১ জনের অনুমতি ছিল মাদক সেবনের। মাদক সেবনের অনুমতি নেই এমন ২৯ ব্যক্তি সাজা পেলেও মদ বিক্রেতা অনুপ বিশ্বাস বরাবরের মতোই রয়ে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে! বৈধ লাইসেন্স নিয়ে অবৈধভাবে মদ বিক্রেতা অনুপ বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে জানিয়েছেন র‌্যাব-৭ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মাশকুর রহমানও।

অভিযানে নেতৃত্বদানকারী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‌’অভিযানের সময় উপস্থিত না থাকলে ভ্রাম্যমান আদালত কোন সাজা দিতে পারে না। অভিযানের সময় যাচাই বাছাই করে সাজা পাওয়ার উপযুক্ত যারা তাদের সাজা দেওয়া হয়েছে।’

বৈধ লাইসেন্স নিয়ে অবৈধ ব্যবসা
অনুপ বিশ্বাস চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানার ফিশারিঘাট এলাকার ১২৮ নম্বর ইকবাল রোডের চারতলা একটি ভবনে মদের মহালের লাইসেন্স পান। এর আগে এ মহালটি ছিল ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায়। ২০০৫ সাল থেকেই মূলত মদের মহালের আড়ালে শুরু হয় চোলাই মদের ব্যবসা। শুরুতে ব্যবসা প্রসারের লক্ষ্যে এলাকার প্রভাবশালী একশ্রেণীর যুবক ও মধ্যবয়স্ক শ্রেণীদের এক থেকে তিন লিটার পর্যন্ত মদ বিনামূল্যে দেওয়া হতো। বিনামূল্যে পাওয়া মদের কিছুটা নিজেরা কিছু সেবন করতো, বাকি মদ অন্যজনের কাছে বিক্রি করে দিতো। এভাবে একসময় এই ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠে।

টাকা ছিটিয়ে প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা
অবৈধ চোলাইমদের ব্যবসাকে নির্বিঘ্ন রাখতে অনুপ বিশ্বাস স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ রাখা ছাড়াও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন উদার হাতে টাকা ছিটিয়ে। এভাবে তার চোলাইমদের অবৈধ ব্যবসা এখন নগরজুড়ে ছেয়ে গেছে।

জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে অনুপ বিশ্বাস জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠতা। জাতীয় পার্টির সুবিধা নিয়ে দীর্ঘ সময় তিনি পাথরঘাটা ২ নম্বর পুলিশ বিটের কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সভাপতি ছিলেন। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সাল থেকে অনুপ বিশ্বাস জাতীয় পার্টির সখ্য ছেড়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

জানা গেছে, অনুপ বিশ্বাস আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে জাতীয় পার্টি করলেও তখন থেকেই ভেতরে ভেতরে সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মোটা অংকের অনুদান দিতেন। এই সময় থেকে মেয়রের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে অনুপের। সিটি মেয়রের পৃষ্ঠপোষকতায় এ সময় অনুপ বিশ্বাস বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট (একাংশ) চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বর্তমানে তিনি ওই সংগঠনের চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি।

সিজেকেএস-তায়কোয়ানডো লীগের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের পাশে বিশেষ অতিথি অনুপ বিশ্বাস।
সিজেকেএস-তায়কোয়ানডো লীগের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের পাশে বিশেষ অতিথি অনুপ বিশ্বাস।

অবৈধ ব্যবসার ঢাল ক্রীড়া অঙ্গন
অনুপ বিশ্বাস বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার (সিজেকেএস) কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। সিজেকেএসের সাধারণ সম্পাদক হলেন সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন। বাংলাদেশ তায়কোয়ানডো দলের ম্যানেজার হিসেবে অনুপ বিশ্বাস গেল বছর ৫ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল তিউনিশিয়া সফর করেন। সিজেকেএস-তায়কোয়ানডো লীগ এবং সিজেকেএস-সিডিএফ প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের স্পন্সরও অনুপ বিশ্বাস এন্ড ব্রাদার্স। গত বছর সিজেকেএস-তায়কোয়ানডো লীগের দুদিনব্যাপী পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের পাশে বিশেষ অতিথি হিসেবে অনুপ বিশ্বাসকে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে।

অনুপ বিশ্বাসের অভয়ারণ্য
রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ার পাশাপাশি প্রশাসনের নীরবতায় অনুপ বিশ্বাস পুরো এলাকাকে মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। মাদকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় প্রতিবাদকারীরা আছেন হুমকিতে। মদব্যবসা সচল রাখতে ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় সুকৌশলে হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর হুমকিও দেন অনুপ বিশ্বাস ও তার সহযোগী সাগরের লালিত সিন্ডিকেট।

মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী যুবকদের একজন মো. এনামুল হক এনাম। গত ৪ এপ্রিল হুমকির ঘটনায় থানায় ডায়েরি না নেওয়ায় তিনি চট্টগ্রাম আদালতে একটি কোর্ট ডায়েরি করেন। তিনি ফিশারীঘাট এলাকার জাফর আহমদের পুত্র। গত সাত বছর ধরে এলাকার হিন্দু ও মুসলিমদের নিয়ে কমিটি গঠন করে মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন।

আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে আসার আগে জাতীয় পার্টি নেতা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর সঙ্গে ছিল অনুপ বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠতা।
আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে আসার আগে জাতীয় পার্টি নেতা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর সঙ্গে ছিল অনুপ বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠতা।

এনামুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে যদি মারাও যাই, তাহলে আমার আফসোস নেই। আমার একটাই দাবি এলাকা থেকে মদের মহাল উচ্ছেদসহ অবাধে মদ বেচাকেনা ও সেবনকারীর উৎপাত বন্ধ হোক।’

১০ জুলাই ‘পথে পথে ঝুপড়ি ফিশারিঘাট থেকে পাথরঘাটা চোলাইমদের অভয়ারণ্য’ চট্টগ্রাম প্রতিদিন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর ক্ষেপে যায় অনুপের অনুসারীরা। বিনামূল্যে যারা অনুপ বিশ্বাসের দোকান থেকে মদ পায় তারা এনামসহ মাদকবিরোধীদের বিরুদ্ধে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সমাবেশও করে।

মানুষের পিঠ ঠেকে যাচ্ছে দেয়ালে
পাথরঘাটার বাসিন্দা স্কুল শিক্ষিকা মুনমুন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ‌’প্রায়ই ফিশারীঘাট এলাকায় মদ সেবনকারীদের হাতে ইভটিজিংয়ের শিকার হই। আমার মতো অনেকেই তাদের হাতে আক্রান্ত হয়েছে। এদের এতো দাপটে আমরা অসহায়।’ ওই শিক্ষিকা পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

পাথরঘাটার আরেক বাসিন্দা থানা ছাত্রলীগ নেতা গোপাল দাশ টিপু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাথরঘাটা ওয়ার্ড এলাকা হিন্দু অধ্যূষিত এলাকা হলেও এখানে দীর্ঘদিন ধরে হিন্দু ও মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে বসবাস করছেন। অনুপ-সাগর নিজেদের মদ ব্যবসাকে আড়াল করতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর হুমকি দিলেও সেটা তার ব্যক্তিগত। তাদের ব্যক্তিস্বার্থে যদি এ ধরনের কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম হয়, তাহলে তার সব দায়দায়িত্ব তাদের।’

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরের সঙ্গী হিসেবে অনুপ বিশ্বাসকে দেখা যায় প্রায়ই।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরের সঙ্গী হিসেবে অনুপ বিশ্বাসকে দেখা যায় প্রায়ই।

ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মশিউর রহমান রোকন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শুধু ফিশারীঘাট নয় পুরো এলাকায় মাদক ছড়িয়ে পড়েছে। এলাকার যুবক থেকে শুরু করে স্কুলের পড়ুয়ারা পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এ মাদক সেবনে। এ এলাকায় কেউ নতুন আত্মীয়তা গড়তে চায় না। একমাত্র সমস্যা এখানে অবাধে মাদক ব্যবসা চলে। আমি মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের পক্ষে একমত পোষণ করছি।’

ব্যাখ্যা চেয়েই দায় সারে নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামীম আহমেদ জানান, ‘অনুপ বিশ্বাস একটি কক্ষ ও নির্দিষ্ট করা সীমানায় ব্যবসা পরিচালনার লাইসেন্স পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে চোলাই মদ বিক্রির অভিযোগ আমরা পেয়েছি। তার কাছে এর ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। তিনি কী ব্যাখ্যা দেন সেটার অপেক্ষা আছি আমরা।’

তবে অনুপ বিশ্বাস শুধুমাত্র মাদক সেবনের অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছেই মদ বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু র‌্যাবের অভিযানে ২৯ জন মাদকসেবী সাজা পেয়েছেন যাদের মাদক সেবনের অনুমতি নেই। এ ব্যাপারেও তার কাছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ব্যাখ্যা চেয়েছে বলে জানিয়েছেন দপ্তরের উপ-পরিচালক শামীম আহমেদ।

এদিকে বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য জানার জন্য অনুপ বিশ্বাসের রবি নম্বরে গত দুইদিন ধরে ফোন করেও তার সাড়া মেলেনি। এমনকি এসএমএস পাঠালেও কোনো ফিরতি জবাব পাওয়া যায়নি।

আজাদ/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!