নিষ্ঠুর থাবা এস আলম পরিবারে, করোনায় অসহায় বিত্তশালীরাও

দেশের শীর্ষ শিল্পগ্রুপ এস আলম এর পরিচালক মোরশেদুল আলমের করুণ মৃত্যুতে হাহাকার চলছে সবার মাঝে। এ মৃত্যুতে আতংকিত হয়ে পড়েছেন দেশের শিল্পপতি ও বিত্তশালীরা। সাধারণ মানুষের মনের দরজায়ও আতংকের কড়া নড়ছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন কি কঠিন মহামারী করোনা; এস আলম গ্রুপের পরিচালকের জীবন কেড়ে নিয়েছেন। চিকিৎসা নিয়েও নানা জল্পনা। ওদের মতো দেশসেরা শিল্পপতিরাও অসহায় করোনা থাবায়!

এমনকি দেশের এই সেরা শিল্প গ্রুপের পরিবারের সদস্যরা এরকম চিকিৎসার কবলে পড়বে কেউ ভাবতেও পারেনি।

কি করুণ দৃশ্য! ছোট ভাই জায়গা ছেড়ে দিলো বড় ভাইকে বাঁচাতে। কি শিক্ষনীয় কঠোর বাস্তবতা! আইসিইউতে জায়গা নেই। টাকার কমতি নেই, কিন্তু বেঁচে থাকার একটু শ্বাসের দরকার। দেশের সব বিমান ভাড়া করে আমেরিকা যাওয়ার ক্ষমতা ছিলো। নিয়তির করুণ ফয়সালায় সব পথ অবরুদ্ধ।

তাঁর মৃত্যু একেবারে হৃদয় নাড়া দিল। সাথে মানবতার একটা নজির রাখলো, তাদের যে ক্ষমতা ছিলো, ইচ্ছা করলে অন্য রোগীকে আইসিইউ থেকে সরিয়ে দিতে পারতো। সেটা করেননি। অন্যের জীবনকে তুচ্ছ করেননি। এটা মানবতার বড় বিজয়। যেখানে করোনার হার। সেখানে মানবতার নজির সৃষ্টি করে গেছেন। অাল্লাহ যেন বেহেশত নসিব করেন।

এস আলম পরিবার মানবিক পরিবার। মানুষের পাশেই তাদের যত অবদান। নিজেদের জীবনের শেষ কঠিন মুহুর্তেও দৃঢ়তায় মানুষের প্রতি ছিলে তাদের অগাধ ভালোবাসা।

২০১৬ সালে ভারত থেকে আমার মাকে নিয়ে চিকিৎসা করার পর দেশে এসে একটা পোস্ট করলাম, মাসুদ সাহেবকে কেন্দ্র করে। সেটা ছিলো এরকম হুবহু। “এস আলম গ্রুপের উচিত একটা আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল করা।’ পোস্টটি করার সপ্তাহখানিক পর এস আলম ভবনে যাই একটা কাজে। মাসুদ সাহেবকে বললাম, ‘ভাই, আপনি একটা হাসপাতাল করেন ভারতের চেন্নাই এ্যাপোলোর মতো। তাঁরা আমাদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায়।’ তাঁকে পোস্টটা দেখলাম। কত লোক এটাতে লাইক দিলো। তখন তিনি বলেছিলেন, আমি ভাবছি। একটা করবো পটিয়ার দিকে। জায়গা খুঁজছি। এটা কেবল ব্যবসা হবে না, সেবাও হবে।’

আমি বললাম,’আপনি বটগাছ। এটা আপনি ছাড়া কেউ পারবে না। আপনার তকদিরে অনেক কিছু ফেভার করে।’ তিনি হালকা হাসি দিয়ে কথা শুনলেন। করার ইচ্ছাটা পুনরায় জানিয়েছিলেন।

ভারতের চেন্নাই আর বেঙ্গলুরে দু’টা হাসপাতাল কিন্তু শহরের অখ্যাত জায়গায়। ভালো চিকিৎসার কারণে মানুষ ছুটছে। আজ আফসোস লাগছে, যদি এদের নিজস্ব বিশ্বমানের হাসপাতাল থাকতো তাহলে মোরশেদুল আলম আইসিইউ এর অভাবে মারা যেতো? হয়তো যেতো হায়াৎ না থাকলে। একটা শান্তনা তো পেত পরিবার। চিকিৎসার ঘাটতি ছিলো না। পরিবারের প্রথম মৃত্যু। বাকিরা লড়াই করছে। কি কঠিন সময় এদের।

হয়তো একজন সাধারণ মানুষ পড়লে এত হইছই হতো না। অনেক সময় ভালো মানুষের মৃত্যু দিয়ে অনেক মানুষকে বাঁচিয়ে দেয়। সবাই নড়েচড়ে বসবে। ভাবতে শুরু করে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমরা কতটা অবহেলা করেছি দেশে চিকিৎসাকে। যেমন-একটা উদাহরণ টানতে পারি, হয়তো বেমানান হবে। উদাহরণটা কেউ ভিন্ন ভাবে নিবেন না। বিশ্বকাপ ফুটবলে পৃথিবীর জুড়ে মানুষের আবেগ থাকে। অনেক সময় ছোট দল রেফারির ভুলে গোলে খেয়ে বিদায় নিলেও ফিফা তেমন আমলে নেয় না, অভিযোগ নেয় না।

সম্ভবত ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ কোয়াটার ফাইনালে জার্মান ও ইংল্যান্ডের খেলায় ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের একটি শর্ট গোল পোস্টের মধ্যবারে লেগে ফিরে যায়। রিপ্লে পরিস্কার দেখা গোল লাইন অতিক্রম করেছে। ছিলো গোল। রেফারি দেইনি। এ খেলায় ইংল্যান্ড হারল। যেহেতু ইংলিশ মিডিয়া শক্তিশালি ছিলো সেহেতু পরের দিন হইচই পুরো পৃথিবীতে ফিফাকে নাস্তাবুদ করলো। সবাই ভাবলো ফিফা এবার নড়বে। শেষমেষ ফুটবলের নতুন আইন হলো ক্রিকেটের মতো। রিপ্লে থার্ড রেফারি থাকলো। বড় দল বিপদে পড়াতে বাঁচালো ছোটরা। করোনাকাল আবারেও সে ঘটনা মনে করিয়ে দিল। আবারো অনুরোধ উদাহরণটি কেউ সিরিয়াসলি নিবেন না।

মোরশেদুল আলম একজন অমায়িক মানুষ ছিলো। এ পরিবারটা এ রকম। এদের সাথে কথা বলেও বুঝা যায় না, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। হৃদয় বড়। ব্যবহারে অন্যান্য উচ্চতায় মুগ্ধতা করেছে এরা সবাইকে। দানে তাদের খ্যাতির সীমানা নেই। ব্যাপকতায় ভরপুর। সরবের চেয়ে নীরবে দান মাসুদ সাহবে বেশি পছন্দ করেন। হয়তো আল্লাহ এদের পরীক্ষা করছে ধৈর্যের। এত বড় বিপর্যয় এরা কখনও পড়েনি।

এদের থেকে অন্যান্য ধনীদেরও ভাবা উচিত। টাকা থাকলেও হবে না। দেশে কিছু করতে হবে। আর বিদেশ চিকিৎসার জন্য নয়। বিদেশের হাসপাতাল দেশে গড়তে হবে। রোগ শোক সব তো অাল্লাহর পরীক্ষা। রোগে ধনী-গরীবের ব্যবধান থাকে না। অাজ বিশ্বময় করোনা থাবায় গরীবেরাও অসহায়, তারচেয়েও বড় অসহায় ধনীরা। টাকা আছে। কিন্তু চাইলে সিঙ্গাপুর আর আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ নেই। যেখানে আমেরিকা নয়, বিশ্বের ২০৭টি দেশ করোনায় তুলোধুনো। অবাক বিশ্ব। এখনো সময় আছে, সবাই মিলে উদ্যোগ নিই, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা আগামীর জন্য কি করবেন, একটু চিন্তা করা উচিত। যে মানব সমাজে বসবাস করি। সে সমাজের মানুষের জন্য কিছু করি।

প্রসঙ্গত, যারা সরকারের সমালোচনা করেছেন কিছুদিন আগে ভিআইপিদের জন্য আলাদা চিকিৎসা ব্যবস্থা করেছে সেটা কোথায়? যদি এ রকম থেকে থাকে, তাহলে মোরশেদুল আলমের করুণ মৃত্যু কেন?

চিলে কান নিয়েছে আর এ কথা শুনে সমানে সমালোচনায় সরকারকে ডুবাতে চেষ্টা ছাড়া আর কিছু ছিল না এসব। বিবেকবানে হোন, মানবিক হন, মানুষ বসবাসের পৃথিবীতে এটাই কাম্য।

লেখক: ক্রীড়া সংগঠক

এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!