নির্বাচন কমিশনের নিলামে বেচা ল্যাপটপেই ২ লাখ রোহিঙ্গা ভোটার

২০০৮ ও ২০১৩ সালে দুই ধাপে প্রায় তিন হাজার স্পেশালাইজড ল্যাপটপ নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওই ল্যাপটপে ছিল নির্দিষ্ট একটি সফটওয়্যার। ওই সফটওয়্যার দিয়ে করা হতো ভোটার তালিকার কাজ। ল্যাপটপগুলো বিক্রি করা হয়েছিল সফটওয়্যারটি ডি-এ্যাক্টিভেট না করেই। এমনকি ল্যাপটপে থাকা হার্ডডিস্কের সমস্ত ডাটা না মুছেই এসব ল্যাপটপ তুলে দেয়া হয়েছিল ক্রেতাদের হাতে।

পরবর্তীতে ওইসব ল্যাপটপের সাযায্যে করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে ভোটার করার কাজ। নিলামের বিক্রি হওয়া বেশ কিছু ল্যাপটপ সুকৌশলে কিনে নেয় নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অসাধু সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটের লোকেরাই এসব ল্যাপটপে থাকা সফটওয়্যারের সাহায্যে বানিয়েছে দুই লাখ রোহিঙ্গা ভোটার। তার মধ্যে অধিকাংশ রোহিঙ্গা ভোটার হয়েছে দেশের ৩২টি উপজেলায়।

দুদক বলছে, ২০০৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের গুরুত্বপূর্ণ তিন জেলাতে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা ভোটার করেছে নির্বাচন কমিশন। তার মধ্যে পাসপোর্ট তৈরি করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা। বাকি ১ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা ভোটার চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানে ৩২টি উপজেলায় বসবাস করছেন।

এমন অবস্থায়, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত তিন জেলাতে সবার জাতীয় পরিচয়পত্র ও স্মার্টকার্ড বাতিল করে নতুনভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার দাবি তুলেছেন দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। একইসঙ্গে এসব রোহিঙ্গাদের পাসপোর্টও বাতিল করার সুপারিশ করা হয়।

জানা গেছে, ২০০৮ সালে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় তিন হাজার ল্যাপটপ পেয়েছিল নির্বাচন কমিশন। এসব ল্যাপটপ দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের কাজ করা হয়। ওই ল্যাপটপে আগে থেকেই ছিল একটি নির্দিষ্ট সফটওয়্যার। সেখানে ইন্টারনেটের মডেমের সাহায্যে কাজ করা হতো ভোটার নিবন্ধনের কাজ। নির্বাচন কমিশনের প্রধান কার্যালয় থেকে সারা দেশে ওই সফটওয়্যারের সাহায্যে নতুন ভোটার তালিকা নিবন্ধন করা হয়।

দুদক সুত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গা নাগরিক ভোটার তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হওয়ার শুরুটা হয়েছিল ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার সময়ে। ওই সময় ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রস্তুতিতে যাচাই-বাছাই না করে লাইন ধরে ছবি তুলে ভোটার হয়েছেন সাধারণ মানুষ।

ওই সময় সুযোগটি পেয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটার হয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। ওই রোহিঙ্গা ভোটারের সূত্র ধরে দেশে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা ভোটার করা হয়। এ জালিয়াতিতে জড়িত রয়েছে ইসি কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রশাসনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি ও দালালচক্র।

দুদক সুত্রে জানা যায়, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও স্মার্ট কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর চলতি বছরের শুরু থেকে পাসপোর্ট সংক্রান্ত ৫টি ও এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় মোট ১৩টি মামলা দায়ের করেছে দুদক। এসব মামলায় মোট ১০৬ জনকে আসামি করা হয়।

এসব মামলায় এ পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার তিন কাউন্সিলরসহ ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও রয়েছেন। বর্তমানে আরও ১২টি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে জানিয়েছেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা।

সর্বশেষ গত ১৭ জুন পুলিশের দেয়া মিথ্যা প্রতিবেদনে পাসপোর্ট পেয়েছে রোহিঙ্গা নাগরিকরা -এমন অভিযোগের দায়ে কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, জেলা বিশেষ শাখার তিন পুলিশ পরিদর্শক বিরুদ্ধে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ১৩ রোহিঙ্গা নাগরিককেও আসামি করে দুদক।

জানা যায়, বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা নাগরিক অনুপ্রবেশ বহু কাল থেকে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর যেসব রোহিঙ্গা এদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় লাভ করেছে তাদের তালিকা করা হয়েছে দু’ভাবে। একটি সরকারিভাবে ও অপরটি বেসরকারি এনজিও সংস্থার মাধ্যমে। তার মধ্যে সরকারি সংস্থার হিসেবে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা সংখ্যা ১১ লাখ।

দুদক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা ভোটার। তার মধ্যে অধিকাংশ রোহিঙ্গারা বানিয়েছে পাসপোর্টও। ভোটার হওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা দেশের বাইরে চলে গেছেন। বাকিরা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানে বসবাস করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জড়িতদের মধ্যে রয়েছে পুলিশ সুপার (এসপি), ডিএসবি, চট্টগ্রামের এসবি শাখার কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি ও দালাল।’

কেএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!