চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা এলাকার বাসিন্দা ফ্যান্সি দত্ত পেশায় একজন স্কুলশিক্ষিকা। গত ৩০ জুলাই টিকা নেওয়ার নিবন্ধন করেছেন তিনি এবং তার পরিবারের আরও ৪ সদস্য। তবে প্রায় মাসখানেক পেরিয়ে গেলেও এখনও তিনি বা তার পরিবারের কেউ টিকা নেওয়ার জন্য কোনো এসএমএস পাননি। তিনি বলেন, তার আরও কয়েকজন সহকর্মীও টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন। কিন্তু তাদেরও তারই মতো অবস্থা। ফ্যান্সি দত্ত বলেন, ‘আমরা কেউই এসএমএস পাইনি। এখন যদি স্কুল খুলে যায় তাহলে তো আবার বিপদে পড়ে যাবো। খুব চিন্তায় আছি এটা নিয়ে।’
দৈনিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও টিকা সম্পর্কিত যে তথ্য দিয়ে থাকে— সে অনুযায়ী, দেশে এ পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ৯০ লাখের মতো মানুষ টিকার জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন। করোনাভাইরাসের টিকা নিতে এই বিপুল পরিমাণ মানুষ নিবন্ধন করলেও এখনও প্রথম ডোজ টিকার জন্যই কোন ক্ষুদে বার্তা বা এসএমএস পাননি তারা। ফলে টিকা নেওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন তিন কোটি ৬৫ লাখের বেশি মানুষ। এদের মধ্যে এক ডোজ টিকা নিয়েছেন এক কোটি ৭৫ লাখ। আর দুটি ডোজই সম্পন্ন করেছেন ৭২ লাখের মতো মানুষ। নিবন্ধন করে টিকার জন্য অপেক্ষায় থাকা মানুষের বিপরীতে সরকারের কাছে সিনোফার্ম ও মডার্না মিলিয়ে টিকার মজুদ রয়েছে ৬৫ লাখ ৩৬ হাজারের কিছু বেশি।
‘টিকার জন্য আটকে আছি’
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকা নিতে হলে সরকারি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নিবন্ধন করতে হয়। পরে মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা বা এসএমএস এর মাধ্যমে টিকা দেয়ার তারিখ জানিয়ে দেয়া হয়। তবে অনেকেই অভিযোগ করেছেন, নিবন্ধনের পর দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও টিকা পাচ্ছেন না। এ নিয়ে ভোগান্তিতে পড়ারও কথা জানিয়েছেন অনেকে। প্রবাসী বাহাউদ্দিন আহমেদ দিপু সম্প্রতি ছুটিতে দেশে ফিরেছেন। ছুটি শেষে সিঙ্গাপুর থাকা তার নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান তাকে ফিরে যেতে বললেও টিকা না পাওয়ার কারণে যেতে পারছেন না তিনি। তিনি জানান, চলতি মাসের ১০ তারিখে টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন। কিন্তু প্রথম ডোজের জন্য এখনো কোন এসএমএস পাননি। বাহাউদ্দিন বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু তারা বলেছে যে, এসএমএস না আসলে কিছু করা যাবে না। ২৫ দিন অপেক্ষা করতে বলছে, এখন সেটাই করছি।’
এসএমএস কিভাবে পাঠানো হয়?
টিকার প্রথম বা দ্বিতীয় ডোজের জন্য তারিখ জানিয়ে এসএমএস পাঠানো হয়ে থাকে নিবন্ধনের সময় উল্লেখ করা টিকা কেন্দ্র থেকে। এসএমএস কিভাবে পাঠানো হয়— সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, যারা আগে নিবন্ধন করেছেন এবং যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি এসএমএস ও টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে একটি টিকা কেন্দ্রের প্রধান এবং ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার জানান, বিপুল সংখ্যক মানুষ টিকার জন্য নিবন্ধন করছে। যার কারণে কেন্দ্রগুলোতে অনেক বেশি নিবন্ধনকারীর সংখ্যা জমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, যে কেন্দ্রে টিকার জন্য নিবন্ধন করা হয় সেখানে নিবন্ধনের আইডি নম্বরটা থেকে যায়। ওই নম্বর অনুযায়ী, যে আগে নিবন্ধন করবে তাকে আগে এসএমএস পাঠানো হয়।
সেই সাথে প্রবাসীদেরও অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা হয়। তবে যারা বিদেশে যেতে চান অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ক্ষেত্রে তাদের হাতে আট সপ্তাহ সময় আছে কিনা সেটি খেয়াল রাখতে হবে।
ডা. আয়শা বলেন, নিবন্ধনের তুলনায় টিকার পরিমাণ কম থাকার কারণে বেশি মানুষকে একসাথে টিকা দেওয়া যায় না। এক কেন্দ্রে হয়তো টিকা দেয়ার সক্ষমতা ৫০০, কিন্তু প্রতিদিন নিবন্ধনই করে ৫-৭ হাজার মানুষ। ফলে বাকিগুলো জমতে থাকে। অনেক বড় কেন্দ্রে এখনো ৫০-৬০ হাজার জমে রয়েছে।
তবে জনবল এবং টিকা দেয়ার সক্ষমতা কম থাকায় অনেক সময় একটি কেন্দ্রে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা জমে যায় বলেও জানান তিনি। ফলে এসএমএস পেতেও দেরি হয়।
‘টিকা পাইপলাইনে আছে’
টিকার জন্য প্রতিদিনই নিবন্ধন করছেন অনেক মানুষ। টিকার স্বল্পতার কথা জানিয়েছেন টিকা বিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য ডা. এএসএম আলমগীরও। তিনি বলেন, এক সাথে এক-দেড় কোটি টিকা দিয়ে দেওয়ার মতো টিকা এই মুহূর্তে তাদের হাতে নেই।
এমন পরিস্থিতিতে এতো বিশাল সংখ্যক মানুষকে কিভাবে টিকা দেওয়া হবে— এই বিষয়ে ডা. আলমগীর জানান, টিকার পর্যাপ্ত মজুদ না থাকলেও টিকা ক্রমান্বয়ে আসছে। যত মানুষ রেজিস্ট্রেশন করেছে তত টিকা হাতে নেই, তবে টিকা আসছে এবং আসবে। আমাদের তো সিনোফার্মের টিকা রেগুলার আসছেই। সাথে কোভ্যাক্স থেকেও টিকা আসছে। এছাড়া আগামী সপ্তাহে ফাইজারের ১০ লাখ ডোজ, সেপ্টেম্বরে ফাইজারের আরো ৫০ লাখ এবং ২৩শে সেপ্টেম্বরে সিনোফার্মের আরো টিকা আসবে।
‘টিকা পাইপলাইনে আছে’— একথা জানিয়ে ডা. আলমগীর বলেন, টিকার জন্য নিবন্ধন করাটাকে এখনও উৎসাহিত করছেন তারা। নিবন্ধন করা থাকলে টিকা নিয়ে পরিকল্পনা করা সহজ হয় এবং সে অনুযায়ী যারা আগে নিবন্ধন করবেন তারা আগে টিকা পাবেন।
‘গণটিকার সিদ্ধান্ত ভুল’
এদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত টিকা হাতে না পেয়ে গণটিকার কার্যক্রম শুরু করাটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তারা বলছেন, গণ টিকা না দিয়ে যদি ওই সময়ে যারা নিবন্ধন করেছে তাদের টিকা দিয়ে দেওয়া হতো তাহলে এতো মানুষকে এখন অপেক্ষা করতে হতো না বলেও মনে করেন তারা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, নিবন্ধন এবং টিকার মজুদের মধ্যে যে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে সেটি কাটিয়ে উঠতে হলে পর্যাপ্ত টিকা হাতে না আসা পর্যন্ত গণটিকার কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে। সেই সাথে সরকারের হাতে এখন যে টিকা আছে এবং যেসব টিকা পাইপলাইনে আছে সেগুলো মিলিয়ে একটি পরিকল্পনা করা যে, যারা নিবন্ধন করেছেন, তাদেরকে দুটি ডোজ টিকাই কত দিনের মধ্যে শেষ করা যাবে তা নিয়ে। পরে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আগাতে হবে।
একই সাথে যেসব মানুষ নিবন্ধন করেননি কিন্তু বয়স বেশি এবং অন্য স্বাস্থ্য সমস্যা বা কো-মরবিডিটি আছে তাদেরকে এর আওতায় আনতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
তবে বাংলাদেশে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন তাদের আরো কতদিন অপেক্ষা করতে হবে সে প্রশ্নের উত্তর এখনও কারও কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।