‘নিধিরাম সর্দার’ তামিম ইকবালের হতাশার অধিনায়কত্ব

কথিত আছে, নিধিরাম নামের একজন লোক এক গ্রামে বাস করতো। সে নিজের সাহস এবং শক্তির কথা জাহির করতে খুবই ভালোবাসতো। গ্রামের লোকও ভাবতো এতোই যখন বলে হয়তো বা সে আসলেই অনেক শক্তিশালী ও সাহসী। তার কথা বিশ্বাস করে সবাই বরং এই ভরসায় থাকতো যে কখনও যদি গ্রামে ডাকাত-টাকাত পরে তাহলে আর চিন্তা নেই, নিধিরাম তো আছেই।

একদিন গ্রামে সত্যিই ডাকাত পরলো। ডাকাত পরলে যা হয় আর কি, একদম গ্রাম শুদ্ধ লুটে নিয়ে গেলো। গ্রামের লোকেরাও নিধিরামের ভরসায় কিছুটা বেখেয়ালই ছিলো তাই তারা কোনো রকমেই তাদের কিছু বাঁচাতে পারলো না। এত বড় ঘটনা যখন ঘটছিলো তখন কিন্তু নিধিরামের ছায়াও কেউ দেখতে পায়নি। মোট কথা নিধিরাম ডাকাতদের সঙ্গে যুদ্ধ করা তো দূরে থাক ডাকাতদের সামনেও পড়েনি।

ডাকাতির এই ঘটনায় গ্রামের মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিলো এই যে নিধিরাম এত বড় বড় কথা বলতো আজ সে কোথায়? নিধিরামকে তারা প্রশ্ন করল, তোমার মতো একজন সর্দার থাকতে এ ঘটনা কীভাবে ঘটলো? নিধিরাম তার কাজের জন্য লজ্জিত হবে কি, উল্টো সবাইকে রাগ দেখিয়ে বলতে লাগলো, আমার কাছে কি কোনো ঢাল-তরোয়াল আছে নাকি যে আমি ডাকাত বধ করবো? যদি ঢাল-তরোয়াল থাকতো তবে দেখিয়ে দিতাম না এক হাত?

উপরের গল্পটির সাথে শ্রীলঙ্কা সফররত বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবালকে মিলাবেন কিনা সেটি একান্তই আপনার ব্যাপার। তবে তামিম নিজে এবং তামিম ঘনিষ্ঠ অনেকেই শ্রীলঙ্কা সফরের আগে এবং শ্রীলঙ্কায় থাকালীন সময়ে অনেকবেশি আশারবাণী শুনিয়েছিলেন। শ্রীলঙ্কাকে হোয়াইটওয়াশের হুমকি, নিজের ব্যাটে রানের ফল্গুধারা আসা, সিনিয়র কয়েকজন খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতিও কোন সমস্যা হবে না…ইত্যাদি সে অনেক কথা। তবে তামিম নিধিরাম সর্দারের মতো এখনব্দি বলেননি, আমারতো মাশরাফির মতো ঢাল আর সাকিবের মতো তলোয়ার ছিল না, আমি কীভাবে লঙ্কাবধ করবো?

'নিধিরাম সর্দার' তামিম ইকবালের হতাশার অধিনায়কত্ব 1
অধিনায়ক যখন হতাশায় ভুগেন তখন দলও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায় না।

অধিনায়কত্বের বোঝা এমনিতেই অনেকের জন্য বড্ড ভারী। বিশ্বকাপ থেকে রানের মধ্যে না থাকা তামিমের ঘাড়ে এই বোঝা চাপানো (পড়ুন-বোঝা নেয়া) ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত ছিল। তামিমসহ অনেকেই ভেবেছিলেন বিশ্বকাপে যারা রান পায়নি তারা সবাই লঙ্কায় রানে ফিরবেন। কিন্তু তামিমসহ সবাই যেই লাউ সেই কদু। এক মুশফিক ছাড়া মুক্তি মিলেনি কারও।

তবে একটা জটিলতা থেকে অন্তত মুক্তি পেয়েছেন তামিম ইকবাল। বেশ লম্বা সময় পরে এই প্রথম ‘বোল্ড’ হওয়া থেকে বাঁচলেন! পেছনের ৬ ম্যাচে বোল্ড হয়েছিলেন। সপ্তম ম্যাচে এসে ক্যাচ আউট হলেন।

তবে পুরানো একটা জটিলতা ঠিকই রয়ে গেলো। ইনিংস গুছিয়ে শুরু করার আগেই আরেকবার আউট। শ্রীলঙ্কায় অধিনায়ক তামিম ইকবালের সিরিজটা শুরু হয়েছিলো শূন্য দিয়ে। শেষ হলো ২ রান দিয়ে। মাঝের ওয়ানডেতে ফিরেছিলেন ১৯ রানে।

তিন ম্যাচে ২১ রান। গড় ৭। ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে প্রথম সিরিজেই হার। পারলে কলম্বোর এই তিন ম্যাচের সিরিজকে শক্ত রাবার দিয়ে ঘসে ঘসে ক্যারিয়ার রেকর্ড থেকে মুছে ফেলতে চাইবেন তামিম।

সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে এই সিরিজে কোনো কিছুই তামিমের পক্ষে যায়নি। না ভাগ্য। না ক্রিকেটীয় পরিস্থিতি। অধিনায়ক হিসেবেও মাঠে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি-যা নিয়ে আলাদা কোনো আলোচনা হতে পারে। বরং সমালোচনা হতে পারে-এমন অনেককিছুই রেখে গেলো তার জন্য তিন ম্যাচের এই সিরিজ।

'নিধিরাম সর্দার' তামিম ইকবালের হতাশার অধিনায়কত্ব 2
ব্যাটিং-বোলিং আর ফিল্ডিং তিন বিভাগেই বাংলাদেশ দলের দৈন্যদশা ফুটে উঠে।

সিরিজ জুড়ে টিভি ক্যামেরা যতবারই তামিম ইকবালকে ক্লোজশটে ধরেছে, প্রায় প্রতিটিতেই একই অনুভুতি ও অনুভবের তামিমকে দেখা গেছে-‘চরম দুঃখী দুঃখী চেহারা!’

হতাশায় কাতর। টেনশনে গালে হাত। আশা ভঙ্গের বেদনায় চোখ ঢেকে ফেলা। কপাল চাপড়ানো। শূন্য দৃষ্টিতে ভরা দু’চোখ। সমস্যার চোরাবালিতে ভারে ক্রমশ যেন নিমজ্জিত মানুষের অসহায়ত্ব তার পুরো অবয়ব জুড়ে।

যে দুঃখী ভঙ্গি নিয়েই সিরিজ শুরু। ভেঙ্গে নুয়ে পড়া সেই অভিব্যক্তি নিয়েই ব্যাট হাতে তামিমের সিরিজ শেষ!

পুরো সিরিজে তামিম কখন হেসেছেন, ঠিক মনে পড়ছে না। সংবাদ সম্মেলনে মুখে হালকা হাসি ধরে রেখেছিলেন। তবে সেই হাসিতে আনন্দের চেয়ে কষ্টের যন্ত্রনা ভোলার আবহ যে বেশি স্পষ্ঠ!

'নিধিরাম সর্দার' তামিম ইকবালের হতাশার অধিনায়কত্ব 3
তামিমের হতাশা

মাত্র এক সিরিজ অথবা তিন ম্যাচ দেখেই যে কোনো বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছানো যায় না। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত অধিনায়কত্ব কারো জন্য আনন্দের। কখনো বা কারোর জন্য বাড়তি বোঝা! তামিম মনে হয় পরের গ্রুপেই পড়বেন।

শ্রীলঙ্কায় এই সিরিজ থেকে হারের সঙ্গে এই শিক্ষা নিয়েও ফিরছে বাংলাদেশ দল। ম্যাচের মাত্র অর্ধেক সময়ে দল যখন সঙ্কটে তখন স্বয়ং অধিনায়কই যদি মুষড়ে পড়েন। হতাশায় কপাল চাপড়ান। তখন সেই ম্যাচের ফল জানতে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষার আর প্রয়োজন পড়ে না।

তামিম ইকবাল এই সিরিজে ব্যাট হাতে আরো অনেকের মতোই ব্যর্থ। কিন্তু ব্যাটসম্যান তামিমের সেই ব্যর্থতার চেয়ে বড় সঙ্কট অধিনায়ক হিসেবে গোটা সময় তার দুঃখী এবং সর্বস্ব হারানোর বেদনার প্রকাশ!

অধিনায়কই যদি হেরে যায়, দল জিতবে কিভাবে?

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!