‘নিখিলের মা’য়ের ৫০ বছরের অপেক্ষা শেষ হল মৃত্যুতে, খোকা আর ফেরেনি

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুরের আঁকাবাঁকা পথ ধরে একটু এগোলে আনন্দবাজার। বাজারের পাশেই ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরে থাকতেন এক বৃদ্ধা। ঠিক যেন সাবিনা ইয়াসমিনের বিখ্যাত গানের সেই নারী— যিনি মধ্য বয়স থেকে খোকা ফেরার আশায় হাত বাড়িয়ে ছিলেন। তার সেই আদরের খোকার নাম নিখিল। আর ছেলের নামেই গ্রামের সবার কাছে তার পরিচিতি ‘নিখিলের মা’। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নিখিলকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা।

ম্বাধীনতার ৫০ বছর পরও শুধু ছেলের অপেক্ষায় প্রহর গুণেছেন ‘নিখিলের মা’। সেই মাঝ বয়স থেকে শতবর্ষী জীবনের ইতি টানার আগ পর্যন্ত তার বিশ্বাস ছিল— ‘খোকা ফিরবে, ঘরে ফিরবে।’

বৃহস্পতিবার (৬ মে) সকালে দীর্ঘ প্রতীক্ষার জীবনের ইতি টেনে ইহধাম ত্যাগ করেন সবার পরিচিত ‘নিখিলের মা’। নিখিলের মায়ের মৃত্যু নিয়ে চট্টগ্রামের একটি দৈনিকের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা তাপস কুমার নন্দী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দিলে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় তার সাথে।

কী নাম ছিল নিখিলের মায়ের— এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেশ মুশকিলে পড়তে হল। সারা গায়ের মানুষ তাকে এক নামে চেনে ‘নিখিলের মা’ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে ছেলে হারানোর পর একলা জীবনে ছেলের স্মৃতিকে একান্ত করে নিতে হয়তো নিজের নাম বাদ দিয়ে ‘নিখিলের মা’ হয়ে থাকাতেই সান্ত্বনা খুঁজেছেন তিনি। আর এজন্য গ্রামের কেউই জানে না নিখিলের মায়ের আসল নাম কী। পরে অবশ্য বয়স্ক ভাতার কাগজপত্র ঘেঁটে জানা গেল নাম তার ‘অমিয় বালা দে’, বয়স ১০৩। দীর্ঘ ১০৩ বছরের জীবনখাতার ৫০ বছরই অমিয় বালার কেটেছে ছেলে নিখিলের প্রতীক্ষায়।

তপন কুমার নন্দী লিখেছেন, ‘নিখিলের বাবা মারা যাওয়ার পর অনেক কষ্ট করে লালন-পালন করেন নিখিলকে। দুঃখ যে কি তা নিখিল কখনো বুঝেনি। নিখিলের মায়ের মুখে শুনছি, বুঝবেই বা কিভাবে তার চাওয়াটা যাই হতো না কেন, শত কষ্ট হলেও তার মা পূরণ করে দিতো। কখনো কিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি তার মা। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে, মাঠে-ঘাটে কাজ করে, এইঘর ওইঘর ঘুরে ঘুরে সংসার চালাতেন। তার স্বপ্ন, আশা তার ছেলে পড়ালেখা করে অনেক বড় হবে। অনেক বড় চাকরি করবে। একদিন অনেক টাকা হবে। তার কষ্টের অবসান ঘটবে। নিখিল পড়ালেখায় অনেক ভালো ছিল। সে গ্রামের স্কুল থেকে ভালো রেজাল্ট করে।’

তাপস কুমার নন্দীর সাথে আলাপ করে জানা গেছে, ৭১-এ ঘাতক পাঞ্জাবিরা একদিন বাড়ি থেকে নিখিলকে ধরে নিয়ে যায়। কয়েকদিন কেটে গেল। কিন্তু অমিয় বালা ছেলে নিখিলের কোন খোঁজ পান না। ছেলের শোকে প্রায় পাগলের মত হয়ে গেলেন তিনি। যাকে দেখে তাকেই নিখিলের কথা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু কেউ নিখিলের খবর দিতে পারে না। একদিন শোনা গেল নিখিলকে পাকিস্তানিরা মেরে ফেলেছে। তবে সে কথা কখনোই মানতে রাজি হননি অমিয় বালা। তার বিশ্বাস ছিল নিখিল ফিরবেই। আর সে প্রতীক্ষায় দিন গুণতে গুণতে বৃদ্ধ হয়ে গেলেন অমিয় বালা।

নিখিল ছাড়াও এক মেয়ে ছিল অমিয় বালার। ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যায় সেও। গ্রামের পাড়াপ্রতিবেশীদের সাথে বেশ সুসম্পর্ক ছিল উনার। খুব গর্ব করে বলতেন মৃত্যুর পর তার শেষ যাত্রার কাপড়টাও কাউকে কিনে দিতে হবে না।

তাপস কুমার দে জানিয়েছেন, শেষকৃত্যের যাবতীয় উপকরণ সবই পাওয়া গেছে অমিয় বালা দে’র আলমারিতে। এমনকি শ্রাদ্ধের খরচের জন্য ১৫ হাজার টাকার সঞ্চয়ও রেখে গেছেন নন্দন নামে স্থানীয় এক সমাজকর্মীর কাছে।

বাঁশখালী উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অসিত সেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটি আসলে শুধু অমিয় বালার গল্প না। বাংলার গ্রামে গ্রামে এমন অনেক হারানোর গল্প আছে। কত ত্যাগ আর বলিদানের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি মাঝে মাঝে মনে হয় আজকের তরুণরা সেটা বুঝতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছুই হচ্ছে। কিন্তু যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার যে, ঠিক কোন্ চেতনাকে সামনে রেখে এমন এক যুদ্ধে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পরেছিল সেটার অনুসন্ধান তরুণদের করতে হবে। সেটা বোধহয় সেভাবে হচ্ছে না।’

এদিকে অমিয় বালা দে’র মৃত্যুর খবর তুলে ধরে তপন কুমার নন্দীর পোস্টে অনেকেই নিজেদের হতাশা ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন। সেটাকে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক মনে করছেন না তিনি। বলেন, ‘দেখুন নিখিল তো শহীদ ছিল। এর কোন স্বীকৃতি সম্মান তো মিলেনি। যে নারী নিজের শেষকৃত্যের সব ব্যবস্থা করে যান তার তো কোন পার্থিব চাওয়া ছিল না। কিন্তু স্বীকৃতি, সেটা তো পেতে পারতো। অথচ সেভাবে কেউ কোনদিন খবরও নেয়নি। ১০৩ বছর বয়সী এই বৃদ্ধা মাত্র বছরতিনেক আগে বয়স্কভাতার সুবিধাভুক্ত হন।’

তবে তাপস কুমার নন্দীর স্ট্যাটাসের পর অনেকেই অমিয় বালার জন্য কিছু করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তাপস জানান, ‘আমাকে অনেকেই ফোন করেছেন যারা কিছু করতে চান। দুবাই থেকে পবন চৌধুরী নামে একজন কল করে বলেছেন তার মা নেই। নিখিলের মায়ের শ্রাদ্ধের জন্য তিনি ৫ হাজার টাকা পাঠাতে চান। এমন অনেকেই যোগাযোগ করেছেন।’

মুক্তিযোদ্ধা অসিত সেন বলেন, ‘কথা ছিল যুদ্ধ শেষ হলে কোনো মা সন্তানহীন থাকবেন না। যুদ্ধে যারা জীবন দেবে তার সহকর্মীরা হবে তার মায়ের সন্তান। ৫০ বছর পরেও যদি সে কথার প্রতিফলন কিছুটা হলেও দেখা যায়, তাহলে যে আশায় যুদ্ধ করেছি সে আশা এখনও জীবন্ত আছে বলে মনে করতে পারি। একটা তৃপ্তি কাজ করে।’

এসএ/এমএফও/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!