নিঃস্ব তারেক সোলায়মান সাহায্য পেয়েছিলেন শুধু এক লাখ টাকা!

জীবনের শেষবেলায় এসে মনোনয়ন পাননি বানোয়াট অপবাদে

‘ইয়াবা ব্যবসায়ী’— কৌশলে এমন একটি অপবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তার নামে। বলা হয়েছিল, অবৈধভাবে গড়েছেন টাকার পাহাড়। অথচ তিনি যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন, চিকিৎসাটা যখন তার জন্য ভীষণ জরুরি হয়ে ওঠে— তখন দেখা গেল এই মানুষটি অনেকটাই কপর্দকশূন্য। চট্টগ্রাম নগরীর বুকে চার চারবারের কাউন্সিলর, অথচ সেই তিনিই হাসপাতালের শয্যায় বসে দিনের পর দিন দরজার দিকে তাকিয়ে থেকেছেন একটু অর্থসাহায্য পাওয়ার আশায়।

তিনি তারেক সোলায়মান সেলিম। চট্টগ্রামে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক সকল আন্দোলন সংগ্রামের সাহসিকতার সাথে নেতৃত্ব দেওয়া পরিচিত এক মুখ। অনটনে থেকেও নিজে কারও কাছে হাত পাততে চাননি। শেষে শরীরে যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ক্যান্সার, তখন নিরুপায় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্য চেয়ে খোলা চিঠি লিখলেন সেলিম। এর বাইরেও নিয়ম অনুযায়ী চিকিৎসার জন্য অনুদান চেয়ে আবেদন করলেন।

সেই আবেদনে সেভাবে সাড়া মেলেনি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুধু পেয়েছিলেন এক লাখ টাকা সাহায্য। চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদদের অনেকেই বলছেন, সাহায্যের সেই আবেদন প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়তো পৌঁছায়নি। পৌঁছালে এমন ত্যাগী নেতাকে প্রধানমন্ত্রী কখনোই এক লাখ টাকায় ফিরিয়ে দিতেন না।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আন্দোলন সংগ্রামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট জিপিও নিউমার্কেট মোড় ও ছাত্রলীগের রাজনীতির তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত সিটি কলেজে তারেক সোলায়মান সেলিমের প্রভাব থাকায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন আন্দোলন-সংগ্রামের সমার্থক। দুরারোধ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করার আগে তাকে পার করতে হয়েছে জীবন সংগ্রামের সবচেয়ে কঠিন সময়টা।

দীর্ঘদিন শিশু সংগঠন খেলাঘর ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে দক্ষ সংগঠক হিসেবে পরিচিত এই নেতাকে শেষভাগে এসে ‘ইয়াবা ব্যবসায়ী’ হিসেবে সমালোচিত হতে হয়েছিল। সেই অপবাদে পর পর চারবারের কাউন্সিলর সেলিমকে দলীয় মনোনয়ন থেকেও বঞ্চিত হতে হয়।

অথচ অসুস্থ হওয়ার পর জানা গেল ক্যান্সারের চিকিৎসা করানোর মতো টাকাই নেই সেলিমের। নিরুপায় হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাহায্য চেয়ে খোলা চিঠিও লিখেছিলেন সেলিম। এর বাইরেও নিয়ম অনুযায়ী চিকিৎসার জন্য অনুদান চেয়ে আবেদনও করেছিলেন তিনি। সেই আবেদনের সাড়া মিলেছিল কি?

এই প্রশ্নের স্পষ্ট কোনো উত্তর মিলেনি। তবে পারিবারিক একটি সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল তারেক সোলায়মান সেলিমের চিকিৎসার জন্য।

শুধুই কি খোলা চিঠি, নিয়ম মেনে অনুদানের জন্য আবেদন করেছিলেন কি তিনি? এই বিষয়ে জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি আবেদন করেছিলেন। আমরা সেজন্য নগর আওয়ামী লীগ থেকে ডিও লেটারও দিয়েছিলাম। কিন্তু সাহায্য পেয়েছিলেন কিনা সে বিষয়ে জানা নেই।’

চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এক লাখ টাকা পাওয়ার কথা তুলতেই নাছির বলেন, ‘আমি আসলেই জানি না এটি নেত্রী পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা। বিষয়টি আমার কাছেও অস্পষ্ট। এক লাখ টাকা যেটা দেওয়া হয়েছে সেটি আসলে প্রধানমন্ত্রী জানেন কিনা নাকি কার্যালয়ের লোকজনই করেছে— সেটিও জানা নেই আমার।’

তারেক সোলায়মান সেলিমের চিকিৎসা নিয়ে আর্থিক সংকটের বিষয়ে আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, ‘তিনি তো মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার পিতা ছিলেন আলকরণ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনিও আজীবন রাজনীতি করেছেন। এর বাইরে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য তো সেভাবে করেননি। পৈত্রিক সম্পত্তি যা ছিল, সেগুলোর আয় দিয়েই জীবনযাপন করতেন। কিন্তু ক্যান্সারের চিকিৎসা তো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে এই বিষয়গুলো সামনে আসে। ওই সময় চসিকের সকল কাউন্সিলর সাধ্যমতো এগিয়ে গিয়েছিল। তার রাজনৈতিক শুভাকাঙ্ক্ষীরাও সাধ্যমতো পাশে থেকেছেন।’

তারেক সোলায়মান সেলিম চট্টগ্রামের প্রগতিশীল আন্দোলনে কেন গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন? এই প্রশ্নটি করা হয়েছিল নগর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমানকে। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘পারিবারিকভাবেই আওয়ামী ভাবধারার রাজনীতির উত্তরাধিকারী ছিলেন সেলিম ভাই। আমরা খুব ছোটবেলা থেকেই একসাথে চলাফেরা করেছি। উনার নেতৃত্বে আমরা খেলাঘর করেছি। উনাদের বাসায় প্রায়ই সংস্কৃতিকর্মী-নাট্যকর্মীদের যাতায়াত ছিল। সবমিলিয়ে খুব চমৎকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক একটা আবহ ছিল উনার ঘরেই।’

তারেক সোলায়মান সেলিমের দীর্ঘ রাজনৈতিক সহযোদ্ধা মশিউর বলেন, ‘সে সময় আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার ছিল বলতে গেলে সিটি কলেজ। এছাড়া জিপিও মোড় নিউ মার্কেট মোড়ের কর্মসূচি ছিল বলতে গেলে অন্যতম প্রধান স্পট। দুই জায়গাতেই তারেক সোলায়মান সেলিম ভাই ছিলেন নেতা। ফলে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সকল প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বিশেষ করে কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। ফলে বারবার আলকরণের মত জায়গা থেকে মানুষের ভোটে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন।’

এমন বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের একজন নেতার বিরুদ্ধে শেষ সময়ে এসে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ ওঠা কি পরিকল্পিত, নাকি অপবাদ দিয়ে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে? এ প্রসঙ্গে মশিউর রহমান বলেন, ‘এটা কেন হয়েছে আমি বলতে পারবো না। তবে আমি এটা কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না। তিনি আজীবন শিশু সংগঠন করেছেন। সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে রাজনীতিকে সংগঠিত করেছেন। তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না।’

তবে এসব অভিযোগ দায়িত্বশীল মহল ঠিকই বিশ্বাস করেছিল। ফলে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছিলেন তিনি। এমনকি শেষকালে প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি না মেলার পেছনে সেসব অপপ্রচারও প্রভাবক হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ।

আর এটিকে ‘রাজনৈতিক অপপ্রচার’ বলে মন্তব্য করেছেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘তারেক সোলায়মান সেলিমকে কখনও সিগারেট খেতেও দেখিনি। তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগটা একেবারেই বায়বীয় আর বানোয়াট ছিল। যে সময় এসব অভিযোগ উঠে তখন আমি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন এজেন্সিতে বলেছিলাম এগুলো সঠিক নয়। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হলোই। গোয়েবলসীয় কায়দায় একটা মিথ্যাকে বারবার বলে সত্যতে রূপান্তরিত করা হলো। আর এর চরম মূল্য দিতে হয়েছে তাকে।’

একসময় জাতীয় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেওয়া তারেক সোলায়মান সেলিম পরে নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এমএ মান্নানের ঘনিষ্ঠ নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরে কোতোয়ালী থানা আওয়ামী লীগের কমিটিকে কেন্দ্র করে তার সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকলে ঘনিষ্ঠ হন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর। একই সময়ে আফসারুল আমিনের সাথেও সেলিমের ভাল সখ্য ছিল। পরে আফসারুল আমিন আর মহিউদ্দিন চৌধুরীর মধ্যে বিভক্তি দেখা দিলে আফসারুল আমিনের সাথেই দেখা যায় সেলিমকে।

২০০০ সাল থেকে টানা ৪ মেয়াদে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া তারেক সোলায়মান সেলিম এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী লড়াইয়ে ছিলেন। মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর সে সময় দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সাথে দেখা করে তিনি বলেছিলেন, ‘বিষ দেন, বিষ খেয়ে মরে যাই।’ যদিও ততদিনে তার শরীরে বাসা বেধেছিল ঘাতকব্যাধি ক্যান্সারের বিষ। আর সে বিষে নীল হয়ে গত ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় মৃত্যু বরণ করেন সেলিম।

মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) দুপুর ২টায় চট্টগ্রাম পুরাতন রেল স্টেশনে তারেক সোলায়মান সেলিমের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!