নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন পুলিশের শাহাদাৎ

ছিলেন পুলিশের সার্জেন্ট। ১৩ বছর আগে পেট্রোল ইন্সপেক্টর হিসেবে পদোন্নতি পেয়েই সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন এবিএম শাহাদাৎ হোসেন মজুমদার। বর্তমানে তিনি সহকারী কমিশনার (এসি) হিসেবে মনসুরাবাদ নতুন পুলিশ লাইন (ডাম্পিংয়ে) কর্মরত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে শুধু তার একার নামেই প্রায় আড়াই কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ মিলেছে। স্ত্রী ও দুই সন্তানের নামে কিছু কিছু সম্পদের হদিস মিললেও দুদক বলছে, নামে-বেনামে আরও সম্পদ থাকার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে তারা।

জানা গেছে, ১৯৮৫ সালের ২৯ অক্টোবর শুরুতে বাংলাদেশ পুলিশের সার্জেন্ট পদে যোগদান করেন এবিএম শাহাদাৎ হোসেন মজুমদার। ২০০৬ সালের ১৬ এপ্রিল পদোন্নতি পেয়ে সর্বপ্রথম পেট্রোল ইন্সপেক্টর হিসেবে যোগদান করেন নগরের পাহাড়তলী এলাকায়। তিনি ফেনী জেলার ফুলগাজী থানার আমজাদহাট ইউনিয়নের মোশারফ হোসেন মজুমদারের পুত্র। পরিবারসহ বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানার দক্ষিণ কাট্টলি ১১৪৮/সি, চুনার ফ্যাক্টরি ঠিকানায় নিজ মার্কেটের ওপরে বসবাস করছেন।

চট্টগ্রামের দক্ষিণ কাট্টলী হালিশহর রোডের শাপলা আবাসিক এলাকায় এবিএম শাহাদাৎ হোসেন মজুমদারের এই ভবনটি হবে ১০ তলা।
চট্টগ্রামের দক্ষিণ কাট্টলী হালিশহর রোডের শাপলা আবাসিক এলাকায় এবিএম শাহাদাৎ হোসেন মজুমদারের এই ভবনটি হবে ১০ তলা।

দুদকের অনুসন্ধানে শাহাদাৎ হোসেন মজুমদার ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে ২ কোটি ২১ লাখ ১৩ হাজার ৯০০ টাকা মূল্যমানের স্থাবর সম্পদ এবং ৪৪ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যমানের অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গেছে। এ হিসেবে তার অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ৬৫ লাখ ৪৪ হাজার ৪০০ টাকা। শাহাদাৎ হোসেন মজুমদারের নিজ নামে দায় রয়েছে ৪৪ লাখ ৬৯ হাজার ৮৯৫ টাকা।

অন্যদিকে এই পুলিশ কর্মকর্তা মোট ৫৮ লাখ ৮৯ হাজার ৪৪৮ টাকা পারিবারিক ব্যয় ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছেন। পারিবারিক ব্যয় ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধসহ তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ৭৯ লাখ ৬৩ হাজার ৯৫৩ টাকা। এই সম্পদ অর্জনের বিপরীতে শাহাদাৎ হোসেন মজুমদারের গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া গেছে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫৩ হাজার ২৩৭ টাকা। ১ কোটি ২ লাখ ১০ হাজার ৭১৬ টাকা আয়ের কোনো উৎস খুঁজে পায়নি দুদক।

শাহাদাৎ হোসেন মজুমদার স্ত্রী ও তার নামে ১১ লাখ ১৩ হাজার ৯০০ টাকার জমি কিনেছেন। ২০০০ ও ২০০৪ সালে ওই কেনা জমির ওপর মার্কেট ও আবাসিক স্থাপনা নির্মাণ বাবদ প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। স্ত্রীসহ এই পুলিশ কর্মকর্তার নামে ২ কোটি ২১ লাখ ১৩ হাজার ৯০০ টাকা স্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুদক।

দুদক সূত্রে জানা যায়, শাহাদাৎ হোসেন মজুমদার ২০০০ সালের ৯ নভেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর দক্ষিণ কাট্টলী মৌজায় দশমিক ০০৯৭ শতাংশ একটি জায়গা কিনে সেখানে ২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়ে মার্কেট ও আবাসিক ভবন নির্মাণ বাবদ ৭৭ লাখ ১৪ হাজার ৯৬০ টাকা ব্যয় করেছেন। কিন্তু অনুসন্ধান চালিয়ে দুদক জেনেছে, ওই জমির ওপর নির্মিত ভবনের মূল্য কমপক্ষে ৯০ লাখ টাকা বা তারও বেশি।

একই মৌজায় পাহাড়তলী থানার দক্ষিণ কাট্টলী শাপলা আবাসিক এলাকায় শাহাদাৎ হোসেন মজুমদারের নিজ নামে কেনা দশমিক ১০ শতাংশ জমির ওপর একটি বহুতল ভবন বর্তমানে নির্মাণাধীন। এর মূল্য কমপক্ষে ৭০ লাখ টাকা হবে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে। এই ভবনের বৈদ্যুতিক মিটারও শাহাদাৎ মজুমদারের নামে। ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, দশতলা এই ভবনের চারতলার কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

অন্যদিকে শাহাদাৎ মজুমদারের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা শিল্পীর নামে হালিশহরের চুনা ফ্যাক্টরি মোড়ে দশমিক ০৪ শতাংশ জমির ওপর আরেকটি বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ চলছে বর্তমানে। এতে ইতিমধ্যে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে।

এবিএম শাহাদাৎ হোসেন মজুমদারের দুই ছেলে। এদের মধ্যে বড় ছেলে সাদমান সাকিব মজুমদার বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার এবং ছোট ছেলে আকিব জাভেদ মজুমদার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ছোট ছেলের পড়াশোনা ব্যয় সম্পর্কে স্পষ্ট কোন জবাব পায়নি দুদক। শুধু তাই নয়, তার স্ত্রী ও সন্তানদের নামে সম্পদের তথ্য চাওয়া হলে তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করায় তাদের নামে-বেনামে আরও প্রচুর সম্পদ থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা।

এদিকে এবিএম শাহাদাৎ হোসেন মজুমদার ও তার স্ত্রীর ও সন্তানদের বিরুদ্ধে জ্ঞাতবহির্ভূত আয়ের উৎস অঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৩ এর ২৬ (১) ধারায় পৃথকভাবে সবাইকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সম্প্রতি শাহাদাৎ হোসেন মজুমদার ও তার স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা চৌধুরী শিল্পী দুদকে তাদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের জন্য সম্পদ বিবরণীর ফরম সংগ্রহ করেছেন।

জানতে চাইলে নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) এবিএম শাহাদাৎ হোসেন মজুমদার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পুলিশের চাকরি নিয়েছি সার্জেন্ট পদে। ২০০৬ সালে পদোন্নতি পেয়ে তিন বছর ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলাম। এরপর গত ১০ বছর ধরে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) পদে দায়িত্ব পালন করছি। পিওএম থেকে সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে পদোন্নতি পেয়েছি। বর্তমানে মনসুরাবাদ নতুন পুলিশ লাইন (ডাম্পিংয়ে) কর্মরত আছি।’

দুদকের তদন্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার পৈত্রিক জমি বিক্রির টাকা, ব্যাংকের ঋণের টাকা ও প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ৩৫ লাখ নিয়ে বহুতল ও মার্কেট নির্মাণ করেছি। এতে আমার ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাতবহির্ভূত সম্পদ কোথায় পেল দুদক?’

দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর উপ-পরিচালক লুৎফুল কবির চন্দন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ট্রাফিক ইন্সপেক্টর এবিএম শাহাদাৎ হোসেন মজুমদার ও তার স্ত্রী-সন্তানদের বিরুদ্ধে ২ কোটি ২১ লাখ ১৩ হাজার ৯০০ টাকার জ্ঞাতবহির্ভূত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে আরও প্রচুর সম্পদ থাকারও সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে তিনি ও তার স্ত্রী দুদকের ফরম সংগ্রহ করে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেছেন। তাদের দেওয়া সম্পদ বিবরণী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করা হবে। অর্জিত সম্পদের বিপরীতে আয়ের উৎস সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে।’

আজাদ/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!