নাফ নদীর পাড়/ ৫২ রাউন্ড গুলিতে দেশসেরা ইয়াবা কারবারি সাইফুলের জীবনাবসান

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ দেশের সবগুলো গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় তিনি ১ নম্বর ইয়াবা গডফাদার এবং পুরো দেশেই তিনি ছিলেন ১ নম্বর মাদক ব্যবসায়ী। দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ থাকার পর ছয় দিন আগে দুবাই থেকে এসে পুলিশের হাতে ধরা দেন ইয়াবা ডন হাজি সাইফুল করিম। আর আজ ৩১ মে মধ্যরাতে টেকনাফ-মিয়ানমারের মধ্যবর্তী নাফ নদীর পাড়ে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেন ৪৫ বছর বয়সী এই বহুল আলোচিত ইয়াবা ব্যবসায়ী।

পুলিশের ভাষ্যে নাফ নদীর বন্দুকযুদ্ধ হল যেভাবে
টেকনাফ থানার পুলিশ জানায়, অস্ত্র আইনে গত ৫ মে দায়ের করা এক মামলায় এবং একই তারিখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা অপর এক মামলার পলাতক আসামি সাইফুল করিম (৪৫) গ্রেপ্তার করা হয়। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, কয়েকদিন আগে ইয়াবার একটি বড় চালান ইঞ্জিনচালিত বোটযোগে মিয়ানমার থেকে এনে টেকনাফ সদর স্থলবন্দরের সীমানা প্রাচীরের শেষ প্রান্তে নাফ নদীর পাড়ে মজুদ করা হয়েছে। ওই তথ্যের ভিত্তিতে ইয়াবা উদ্ধারের জন্য ৩১ মে রাত সাড়ে ১২টায় ওই স্থানে পৌঁছলে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে সাইফুল করিমের অন্য সহযোগী অস্ত্রধারী ইয়াবা ব্যবসায়ীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে।

এতে ঘটনাস্থলে টেকনাফ থানার এসআই রাসেল আহমেদ, কনস্টেবল ইমাম হোসেন ও মো. সোলেমান আহত হন। টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের তাৎক্ষণিক নির্দেশে নিজেদের জীবন ও সরকারি সম্পত্তি রক্ষার্থে পুলিশ ৫২ রাউন্ড গুলি করে। একপর্যায়ে আটককৃত মো. সাইফুল করিম গুলিবিদ্ধ হন। গোলাগুলির শব্দ শুনে ঘটনাস্থলে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসতে থাকলে পুলিশ গুলি করা বন্ধ করে।

একপর্যায়ে ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্রধারী মাদক ব্যবসায়ীরা গুলি করতে করতে দ্রুত পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকায় ব্যাপক তল্লাশি চালিয়ে আসামিদের বিক্ষিপ্তভাবে ফেলে যাওয়া ৯টি এলজি, ৪২ রাউন্ড শর্টগানের তাজা কার্তুজ, ৩৩ রাউন্ড কার্তুজের খোসা এবং এক লাখ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে।

রাত দেড়টার দিকে গুরুতর আহত গুলিবিদ্ধ মো. সাইফুল করিমকে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখানে পৌঁছানোর পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সুসময় তখন: আব্দুর রহমান বদির সঙ্গে সাইফুল করিম
সুসময় তখন: আব্দুর রহমান বদির সঙ্গে সাইফুল করিম

সাইফুলের বিরুদ্ধে যত মামলা চট্টগ্রাম ও টেকনাফে
ক্রসফায়ারে নিহত সাইফুল করিমের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় অস্ত্র আইনে দুটি (নং-১৫/৩৩৬ ও নং-১০), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি (নং-১৫/৩৩৭ ও নং-১১), চট্টগ্রামের ডবলমুরিং মডেল থানায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে একটি (নং-৫৬) ও দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে (নং-২৭ (১)), টেকনাফ থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে (নং-৪৩/৬৮২) একটি, চট্টগ্রামের হালিশহর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি (নং- ১(৫)১৮) মামলার খোঁজ মিলেছে।

ছয় দিন আগে আত্মসমর্পণ হয়েছিল যেভাবে
দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ থাকার পর অবশেষে ২৫ মে আত্মসমর্পণ করেন ‘ইয়াবা ডন’ সাইফুল করিম। শনিবার রাত ১১টার দিকে দুবাই থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেন হাজি সাইফুল করিম। এ সময় ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে হেফাজতে নেয়। পরদিন সকালের দিকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। এরপর থেকে পুলিশের হেফাজতে তাকে পুলিশ লাইনে রাখা হয়। কথা ছিল, ঈদের পর একটি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অন্যান্য ইয়াবা কারবারিদের সঙ্গে আত্মসমর্পণ করবেন সাইফুল।

খাতুনগঞ্জ থেকে মংডু
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের শিলবুনিয়া পাড়া এলাকার পল্লী চিকিৎসক মো. হানিফের ছেলে সাইফুল করিম। ১৯৯৮ সালের দিকে চট্টগ্রাম হাজি মহসিন কলেজে পড়াশোনার সময় চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ এলাকায় টেকনাফের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর পণ্য কেনাবেচায় সহায়তা করে পড়াশোনা ও থাকা-খাওয়ার খরচ মেটাতেন তিনি। অভাব অনটন ছিল তার পরিবারের নিত্যসঙ্গী। এই সময় তার দাদার বাড়ি মিয়ানমারের মংডু এলাকার ইয়াবা ডন ও মিয়ানমারের শীর্ষ ইয়াবা কারবারি মগা সুইবিনের সঙ্গে সাইফুলের সখ্য গড়ে উঠে। তাদের সহায়তায় ২০০০ সালের দিকে টেকনাফ স্থলবন্দরে এসকে ইন্টারন্যাশনাল নামে আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ ব্যবসা শুরু করেন তিনি। পরের বছরেই টেকনাফের প্রভাবশালী বিএনপি নেতা ও উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহর বোনকে বিয়ে করে টেকনাফ স্থলবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নেন সাইফুল। মূলত তখন থেকেই মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানির আড়ালে ইয়াবা আমদানি করতে শুরু করেন সাইফুল।

মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় স্থাপিত অন্তত ৩৮টি ইয়াবা কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবার প্রায় সবই আসতো সাইফুলের কাছে। ইয়াবা ব্যবসার সুবিধার্থে মিয়ানমার-বাংলাদেশের মধ্যে চলাচলকারী একাধিক জাহাজও কেনেন সাইফুল।

রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ
এ সময় সাইফুল আর তার পরিবারের অবস্থা দ্রুত বদলে যায়। রাতারাতি তারা হয়ে উঠেন শত শত কোটি টাকার মালিক। কক্সবাজারে আবাসিক হোটেল ছাড়াও ঢাকা ও চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের মালিকানা ছাড়াও স্বনামে-বেনামে প্রচুর সম্পদের অধিকারী হয়ে যান সাইফুল করিম ও তার পরিবার। ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের সঙ্গে জড়িত থাকলেও টেকনাফ-উখিয়া আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির সঙ্গে সাইফুল করিম গড়ে তোলেন ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক। প্রশাসন থেকে শুরু করে সব দলের রাজনীতিবিদই তার হাতের নাগালে ছিল।

প্রকাশ্যে সিএণ্ডএফ, আড়ালে ইয়াবা
কাগজে-কলমে সাইফুল করিম টেকনাফ স্থলবন্দরের একজন সিএণ্ডএফ (আমদানি-রপ্তানিকারক) ব্যবসায়ী। প্রকাশ্যে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে কাঠ আমদানির কথা বলা হলেও আড়ালে তার মূল ব্যবসা ইয়াবা। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে করা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সর্বশেষ তালিকায় ‘এক নম্বর ইয়াবা ব্যবসায়ী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে টেকনাফের শীলবনিয়া পাড়ার এই হাজী সাইফুল করিমকে।

আগাগোড়া এক ইয়াবা পরিবার
সরকারি বিভিন্ন সংস্থা প্রণীত প্রায় প্রতিটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তালিকায় শীর্ষে সাইফুল করিম এবং তার পরিবারের সদস্যদের নাম রয়েছে। তার পাঁচ ভাইয়ের বিরুদ্ধেও ইয়াবা ব্যবসায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে গত ৩ মে টেকনাফ থানার পুলিশ অভিযান চালিয়ে সাইফুলের ছোট ভাই মাহবুবুল করিম ও রাশেদুল করিমকে টেকনাফের নিজ বাড়ি থেকে ১০ হাজার ইয়াবা ও চারটি অস্ত্রসহ আটক করে। এই দুই ভাই চট্টগ্রাম বার্তা টোয়েন্টিফোর নামের একটি অনলাইন পোর্টালের সম্পাদক পরিচয় দিতেন। এর আগে গত বছর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আটক হন সাইফুলের বড় ভাই মুন্না। জেড করিম জিয়া নামে তার আরেক ভাইও সাংবাদিক পরিচয়ের আড়ালে ইয়াবা ব্যবসা করতেন। সাইফুলের ভগ্নিপতি সাইফুল ইসলামও ইয়াবা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। আরেক ভগ্নিপতি আবদুল্লাহ মনির টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র। তিনিও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। এছাড়াও তার মামা মিয়ানমারে মংডুর আলী থাইং কিউ এলাকার মোহাম্মদ ইব্রাহিমও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এদিকে গত এপ্রিলেও দুদকের পক্ষ থেকে সাইফুল করিমের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।

এডি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!