নতুন প্রক্টর নিয়ে চবিতে তোলপাড়, ফেসবুকে কথার ঝড়

প্রক্টর অফিস ঘিরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে চলছে ‘রাজনীতি’। নতুন প্রক্টর নুরুল অজিম সিকদার ছাত্রজীবনে শিবির নাকি ছাত্রলীগ করতেন— এ নিয়েও বিতর্কে মেতে উঠেছেন অনেকে।

ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা দাবি করেছেন নতুন প্রক্টর ছাত্রজীবনে শিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যদিও এখন পর্যন্ত ওই দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি তারা। তবে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা বলছেন, নুরুল আজিম সিকদার পারিবারিকভাবেই আওয়ামী লীগ। তার পরিবারের অন্তত ১০ জন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের পদধারী। ছাত্রজীবনেও তিনি এলাকায় ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে কোনো পদে ছিলেন না তিনি।

গত ১২ মার্চ প্রক্টর রবিউল হাসান ভূইয়ার পদত্যাগের পরপরই মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক নুরুল আজিম সিকদারকে প্রক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যোগদানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সহকারী প্রক্টর জিয়াউল ইসলাম সজল ও মোহাম্মদ ইয়াকুব পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করা ওই দুই সহকারী প্রক্টর সদ্য সাবেক প্রক্টর রবিউল ইসলাম ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন হলুদ দলের সদস্য নুরুল আজিম সিকদার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯৫-১৯৯৬ সেশনের শিক্ষার্থী। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ২০১১ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে যোগদান করেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা গেছে, প্রক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহবুব এলাহী তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে নুরুল আজিম সিকদারকে ‘শিবির কর্মী’ আখ্যা দিয়ে পোস্ট দেন। মাহবুব এলাহীর ওই পোস্ট ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজনকে ফেসবুকে শেয়ার করতেও দেখা যায়। এরপর সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে কয়েকজনের নাম দিয়ে একটি বিবৃতির ছবিও পোস্ট দেন তিনি। তবে যাদের পক্ষ থেকে এই পোস্ট দেওয়া হয়েছে তাদের অনেকেই এই বিবৃতিকে সমর্থন করছে না।

উত্তর জেলা যুবলীগের বর্তমান সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক এসএম রাশেদুল আলম বলেন, ‘মাহবুব এলাহীর মত একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যখন নুরুল আজিম সিকদারকে শিবির বলে পোস্ট দেয় তখন আমিও মনে করেছিলাম তা সত্য। পরবর্তীতে আমি রাঙ্গুনিয়া পৌর মেয়র শাহজাহান সিকদার ও রাঙ্গুনিয়া যুবলীগের সভাপতি আরজু সিকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারা আমাকে জানালেন, নুরুল আজিম সিকদার ছাত্রজীবনের শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। পরে আমি আরও কয়েকজন থেকে জেনে নিশ্চিত হলাম, ফেসবুকে ভুল তথ্যই ছড়ানো হয়েছে। এমন পরিবারের কারও অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি মাহবুব এলাহীর ফেসবুকে দেওয়া বিবৃতিতে নাম থাকা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও উত্তর জেলা যুবলীগের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও পাঠাগার সম্পাদক জয়নাল আবেদিন ওই বিবৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। একে তিনি ‘ফায়দা লোটার বিবৃতি’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘চবির পরিস্থিতি নিয়ে আমার আদর্শিক জায়গা থেকে আমি যে কোনো অন্যায়-অনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে সবসময়ই প্রতিবাদ করেছি, এখনও করছি এবং ভবিষ্যতেও করবো ইনশাআল্লাহ। কিন্তু আমার-আমাদের নাম ব্যবহার করে কোনো ফায়দা লোটার সুযোগ কাউকে দিইনি, দেবোও না কখনও। আশা করি কোনো ধরনের ফায়দা হাসিলের জন্য আমার নাম/মাথা বিক্রি করবেন না দয়া করে। আমি কোন ধরনের ফায়দা লোটার বিবৃতিতে সম্পৃক্ত নই। যারা আমার নাম ব্যবহার করেছেন দয়া করে আমার নাম সরিয়ে নেবে।’

বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সদ্যঘোষিত চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের বর্তমান কমিটির জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক কাজে আমি নিজেকে জড়াতে চাচ্ছি না। এগুলো আমার ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এসব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিষয়। বিবৃতিতে ছোট ভাইরা আমার নাম তুলে দিয়েছে। তাদের তো আমি সহযোগিতা করি সবসময়। এখন যদি আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে বলি, তাহলে তারা ছোট হবে।’

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের দাবি, রাঙ্গুনিয়ায় আওয়ামী রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ নুরুল আজিম শিকদারের পরিবার। তার দুই ভাই যুবলীগের পদে আছে, ছোট ভাই আছেন উত্তর জেলা ছাত্রলীগের পদে। তার চাচা সাদেকুন নুর শিকদার রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই দফা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯১ সালে রাঙ্গুনিয়া আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। পরবর্তীতে যদিও দলীয় সিদ্ধান্তে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘নুরুল আজিম সিকদার আমার সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছেন। তার পুরো পরিবার রাঙ্গুনিয়ায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। বিভিন্ন পদে থেকে তারা সংগঠনকে এগিয়ে নিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা যারা তাকে নেতিবাচক কথা বলছে তারা তার পরিবারের বিষয়ে হয়তো জানেন না।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উত্তর জেলা যুবলীগের বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক এমএ খালেদ চৌধুরী বলেন, ‘নুরুল আজিম সিকদার স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যখন ছিলেন তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম না। তাই তিনি কোনো আদর্শের লোক তা আমার জানার সুযোগ নেই। তবে আমি জেনেছি, রাঙ্গুনিয়ায় ওনার গোটা পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল টিপু বলেন, ‘প্রক্টরের দায়িত্ব নেওয়ার পর বড় ভাইদের কেউ কেউ ওনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলছেন, তার সপক্ষে যদি প্রমাণ পাই তাহলে আমরাও তাদের সমর্থন করবো। প্রমাণ ছাড়া তো কার বিরুদ্ধে বলা যায় না। আমরা শিক্ষার্ধীদের ন্যায্য দাবি আদায় ও ক্যাম্পাসের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদার স্যারের সহযোগিতা চাই।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব পালনে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করছি। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রক্টরিয়াল বডিকে নিয়ে আমি সচেষ্ট থাকবো। আর যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তা মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট, অমূলক।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!