‘ধন্যবাদ বাংলাদেশ, আইসিইউ আর লাগবে না’

চট্টগ্রামে এক মুক্তিযোদ্ধার করুণ মৃত্যু চিকিৎসা না পেয়ে

মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমানের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে মারিয়া তাহা শুক্রবার (১২ জুন) সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তার মুমূর্ষু বাবার জন্য একটি আইসিইউ বেড চেয়ে আকুতি জানিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। এর ঠিক তিন ঘন্টা পর রাত ১০:৩৪ মিনিটে ছোট্ট আরেকটি স্ট্যাটাস দেন— ‘আইসিইউ আর লাগবে না।’

শুক্রবার এই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের স্বজনরা রাস্তায় পা লাগাতে দেননি। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হন্যে হয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন একটি আইসিইউ বেডের জন্য। চট্টগ্রাম নগরীর এমন কোনো বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক নেই, যেখানে তারা একটি আইসিইউ বেডের জন্য আকুতি-মিনতি জানাননি।

সারা দিনের সমস্ত চেষ্টা বিফলে যাওয়ার পর স্বজনদের চোখের সামনেই ৭০ বছর বয়সী মানুষটি তিলে তিলে এগোতে থাকেন মৃত্যুর দরজার দিকে। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে জেতা সেই বাবা মাত্র একটি আইসিইউ বেডের কাছে হেরে যাচ্ছেন— সবারই তখন জানা হয়ে গেছে। অন্যদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েটিও বুঝে যান, তার বাবাকে আর কেউ ফেরাতে পারবে না। ফেসবুকটা খুলে কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি লিখলেন শুধু একটি লাইন— ‘আইসিইউ আর লাগবে না।’

‘ধন্যবাদ বাংলাদেশ, আইসিইউ আর লাগবে না’ 1

বুধবার (১০ জুন) রণাঙ্গনে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমানের হালকা জ্বর ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। পরদিন হঠাৎ করে বেড়ে যায় শ্বাসকষ্ট। বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় নগরের সিএসসিআর হাসপাতালে। ভর্তির আশ্বাস পেয়ে সেখানে তাকে নিয়ে যান স্বজনরা। কিন্তু রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার পর শ্বাসকষ্ট দেখামাত্রই মুখ ফিরিয়ে নেয় সিএসসিআর। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিলেও সেগুলোকে পাত্তাই দেয়নি হাসপাতালটি।

এরপর ওই রাতেই বাধ্য হয়ে মিজানুর রহমানকে আবার বাসায় নিয়ে আসেন তার স্বজনেরা। পর দিন শুক্রবার (১২ জুন) সকাল থেকেই তীব্র হতে থাকে তার শ্বাসকষ্ট। বিকেল তিনটার দিকে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ভর্তির পর শ্বাসকষ্ট আরও বাড়তে থাকলে তাকে আইসিইউ বেডে নেওয়ার জন্য স্বজনরা শত আকুতি জানালেও কোন লাভ হয়নি। বরং তাকে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হয়। মুমূর্ষু মিজানুর রহমানকে অক্সিজেন দিয়ে সাধারণ একটি বেডে রাখা হলেও কোনো চিকিৎকের দেখা মেলেনি।

পরে ওই পরিবারের সদস্যরা বের হয়ে একটি আইসিইউ বেডের খোঁজে ছুটলেন বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে। কেউ গেলেন পার্কভিউ হাসপাতালে, কেউবা মা ও শিশু হাসপাতাল। অন্যদিকে কেউ গেলেন ম্যাক্স হাসপাতালে। কেউবা আবার সার্জিস্কোপ হাসপাতাল ও শেভরণে গিয়েও আকুতি জানালেন। কিন্তু না, শ্বাসকষ্টের কথা শুনে কেউ রাজি হল না। শেষমেশ নগরীতে ক্লিনিক সিন্ডিকেটের গড়া করোনার কথিত হাসপাতাল হলি ক্রিসেন্টেও গেলেন স্বজনরা। না, সেখানেও নিলো না।

পরে নিরূপায় হয়ে স্বজনরা পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, চিকিৎসক নেতাসহ অনেকের কাছেই ফোনে একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য একটি আইসিইউ বেডের ব্যবস্থার জন্য আকুতি মিনতি করেন। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি।

মুমূর্ষু মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান দীর্ঘ ৯ ঘন্টা জীবনটা বাঁচানোর লড়াই করে শুক্রবার রাত ১১টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।

শনিবার (১৩ জুন) তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ওই দিন মিজানুর রহমানের মেয়ে মারিয়া তাহা ফেসবুকে লিখেছেন— ‘আপনাদেরকে তো আব্বু একটা স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছে, সেই দেশের হয়ে একটা আইসিইউ তাকে দিতে পারলেন না। ধন্যবাদ বাংলাদেশ।’

মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমানের পৈত্রিক বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া নবীনগরের রতনপুর হলেও তিনি আগ্রাবাদের নাজিরপুল এলাকার নিজ বাসায় থাকতেন। তিনি নিজের মুক্তিযোদ্ধা পেনশনের টাকাটাও দাতব্য হাসপাতালে দান করে গেছেন।

একজন মুক্তিযোদ্ধার নগরের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা না পাওয়া এবং চট্টগ্রাম মেডিকেলে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। তাদের মতে একজন মুক্তিযোদ্ধাই যদি চিকিৎসা না পান, তাহলে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা?

ওই মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করা হাসান মাহমুদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (১১ জুন) রাত থেকে তাকে হাসপাতালে ভর্তির জন্য দৌড়াদৌড়ি করছিলাম। নগরের ছয়টি বেসরকারি হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করে কোথাও একটা আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করতে পারিনি। শেষে বিভিন্ন জনের কাছে ফোন করে সহযোগিতা চেয়েছি। কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধার জন্য একটি আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করতে পারিনি।’

মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহবায়ক সালাউদ্দিন সাকিব বললেন, ‘দিনভর দৌড়াদৌড়ি ও নানা জায়গায় কল করেও একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য একটি আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করতে না পারার চেয়ে কষ্টের আর কিছু নেই। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমি লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!