দেড় বছর ধরে বন্ধ চবিতে ২০ পদের ‘চাঁদার জুলুম’ ঘরে থাকা শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে

করোনাভাইরাসের কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)। ওই একই সময় ধরে বন্ধ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আবাসিক হলও। তবে এই দীর্ঘসময় ধরে শিক্ষার্থীরা বাড়িতে অবস্থান করলেও তাদের ঠিকই দিতে হচ্ছে আবাসিক, পরিবহন, লাইব্রেরিসহ সব ধরনের ফি। কোনো ধরনের সুবিধা না নিয়েই এসব ফি পরিশোধ করতে বাধ্য হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই। তাদের দাবি, করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের ফি যেন মওকুফ করা হয়। শিক্ষার্থীরা বলছেন, করোনাকালীন অনটনের মধ্যেও এভাবে ফি আদায় অনেকটা জুলুমের মতো।

জানা যায়, ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউট পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। আবার অনেক বিভাগ পূর্বে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করছে। ফলে পরীক্ষায় অংশ নিতে ও পরবর্তী বর্ষে ক্লাস করতে শিক্ষার্থীদের ভর্তির তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। এ সময় শিক্ষার্থীদের সিট ভাড়া, হল ইউনিয়ন ফি, হল ক্রীড়া ফি, বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া ফি, লাইব্রেরি ফি, ল্যাবরেটরি ফি, পরিবহন ফিসহ সব ধরনের ফিসই দিতে হচ্ছে।

বিভিন্ন বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ভর্তি রশিদ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জননেত্রী শেখ হাসিনা হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞান অনুষদের মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ভর্তি ফি ১১৩ টাকা, বেতন ৩৩০ টাকা, গ্রন্থাগার ফি ২২৩ টাকা, ল্যাবরেটরি ফি ৩২৭ টাকা, রেজিস্ট্রেশন ফি ৩৬৩ টাকা, হল উন্নয়ন ফি ৫৮, হল ক্রীড়া ফি ৫৮, হল ইউনিয়ন ফি ৫৮, বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া ফি ৫৮, সিট ভাড়া ৪৪০, সংস্থাপন খরচ ৪৪০, আবাস পরিদর্শন ফি ১১, ছাত্র সাহায্য তহবিল ফি ২৫ টাকা, ছাত্রকল্যাণ তহবিল ফি ১১ টাকা, ছাত্রকল্যাণ ফি ১১ টাকা, পরিচয়পত্র ফি ২২ টাকা, রোভার স্কাউটস ফি ২২ টাকা, উস ফি ২৪ টাকা, বিএনসিসি ফি ৪০ টাকা, চিকিৎসা ফি ৬১ টাকা, গ্রন্থাগার কার্ড ফি ৩০ এবং সেশন ফি ২২০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। যার মোট পরিমাণ ৩ হাজার ১১০ টাকা। তবে বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদভুক্ত বিভাগের শিক্ষার্থী না হলে ল্যাবরেটরি ফি দিতে হয় না। তবে বিভাগ, বর্ষ ও হলভেদে টাকার পরিমাণে কিছুটা তারতম্য হলেও তা খুবই সামান্য।

অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞান অনুষদভুক্ত অর্থনীতি বিভাগের অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ২ হাজার ২৫০ টাকা ফি। যদিও বিভাগ ও বর্ষভেদে টাকার পরিমাণে কিছুটা তারতম্য হয়। এ বিভাগে যে যে খাতে ফি নেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে ভর্তি ফি ১১২ টাকা, বেতন ২৬৪ টাকা, গ্রন্থাগার ফি ২২৩ টাকা, রেজিস্ট্রেশন ফি ৩৫৩ টাকা, হল উন্নয়ন ফি ৫৮ টাকা, হল ক্রীড়া ফি ৫৮ টাকা, হল ইউনিয়ন ফি ৫৮ টাকা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া ফি ৫৮ টাকা, আবাস পরিদর্শন ফি ১১, ছাত্র সাহায্য তহবিল ফি ২৫ টাকা, ছাত্র কল্যাণ তহবিল ফি ১১ টাকা, ছাত্র কল্যাণ ফি ১১ টাকা, পরিচয়পত্র ফি ২২ টাকা, রোভার স্কাউটস ফি ২২ টাকা, পরিবহন ফি ৫৭৯ টাকা, উস ফি ২৪ টাকা, বিএনসিসি ফি ৪০ টাকা, চিকিৎসা ফি ৬১ টাকা, গ্রন্থাগার কার্ড ফি ৩০ টাকা এবং সেশন ফি ২২০ টাকা।

শিক্ষার্থীদের দাবি, করোনায় একদিকে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকা অন্যদিকে টিউশনসহ পার্টটাইম চাকরি বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা অনেকটা বেকার সময় পার করছে। এ সময় হাত খরচটুকুও পরিবার থেকে নিতে হচ্ছে। এছাড়া প্রায় সবারই পরিবারের আয়ের অবস্থাও অনেকটা নাজুক। এমন পরিস্থিতিতে হলে না থেকে হল ফি, পরিবহন ব্যবহার না করে পরিবহন ফিসহ অন্যান্য ফি আদায় তাদের জন্য অনেকটা জুলুমের মতো। তাই সব ধরনের ফি মওকুফের দাবি জানান তারা। পাশাপাশি যারা টাকা জমা দিয়েছেন তাদের টাকা ফেরত দেওয়ারও দাবি জানান তারা।

আরবি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আব্দুল মুকাদ্দিম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনার কারণে টিউশন ও পার্টটাইম জব বন্ধ। এখন এমন অবস্থা নিজেই চলতে পারি না। সেখানে প্রশাসন কোন্ জ্ঞানে পরিবহন ফি, হল ফি, বাসন বাবদ ফি ইত্যাদি ফি আদায় করে বুঝতেছি না। প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্ত মোটেও ছাত্রবান্ধব নয়। দ্রুত আমাদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা ফেরত চাই।’

ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী রিপন সরকার বলেন, ‘যেখানে আমাদের জন্য এখন এক টাকাও খরচ হচ্ছে না। সেখানে কেন আমাদের থেকে সব আদায় করা হচ্ছে? অবিলম্বে সব ফি আদায় বন্ধ করা হোক।’

মো. নিজাম নামের এক শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার নামক একটি গ্রুপে লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ১৫ মাস এরও ওপরে। শাটল ট্রেনও অফ গত মার্চ থেকে। এই পরিবহন ফিটা কার পকেটে যাবে? অথচ করোনা মহামারিতে এমনিতেই সকলের অবস্থা যেখানে নাজুক, সেখানে চাইলেই ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ পারতো খরচ কমাতে।’

গালিব শাহরিয়ার নামের আরেক শিক্ষার্থী মন্তব্য করেন, ‘টাকাই যখন নিচ্ছে, তবে হল খুলে দিক এবং ট্রেনও চালু করুক। আমরা ভালোভাবে পরীক্ষা দিয়ে দেই। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের সুবিধা ওপরমহলের সহ্য হয় না।’

এদিকে করোনাকালে শিক্ষার্থীদের সব ধরনের ফি মওকুফ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে শিক্ষার্থীদের সহায়তা প্রদানের দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা।

শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনার সময়ে শিক্ষার্থীদের নিজেরাই চলতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেখানে বিশাল অংকের এই ফি তারা কিভাবে দেবে? যেখানে শিক্ষার্থীরা একদিনের জন্যও কোনো সুবিধা ভোগ করে নাই, তারা কেন সব ফি দেবে? এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। আমরা দ্রুত এই ফি মওকুফের দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় সংকোচন হয়েছে, সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার দাবি জানাচ্ছি।’

শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি গৌরচাঁদ ঠাকুর বলেন, ‘করোনাকালীন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত খরচ আসলে তেমন কিছুই করতে হচ্ছে না। দীর্ঘ দেড় বছর বন্ধ থাকার পর আমরা দেখতে পাচ্ছি শিক্ষার্থীদের ওপর অন্যান্য সময়ের মত নিয়মিত সকল ফি চাপানো হচ্ছে। এটা নিতান্তই অমানবিক আচরণ। যে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস, হল, ক্লাসরুম, লাইব্রেরির কোনো সুবিধাই ভোগ করলো না তারা সেসবের ফি কেন দেবে? চিরাচরিত পদ্ধতিতে ফি আদায়ের সময় এটা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের উপর আরোপিত বিভিন্ন ফি প্রত্যাহার করে শুধু ন্যায্য ও যৌক্তিক ফিটুকুই গ্রহণ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর এস এম মনিরুল হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের টাকা বিশ্ববিদ্যালয় অন্য খাতে ব্যয় করে না। যে খাতের টাকা সে খাতের জন্যই থেকে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনে করে এই টাকা অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে, তাহলে ফেরত দিতে কোনো অসুবিধা হবে না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!