দেশীয় গরু মাত্র ৩ মিনিটে প্রসেসিং : চট্টগ্রামে মাংসের চাহিদা পূরণে আসছে বেঙ্গল মিট

বিশেষ রিপোর্ট :

ভোজন রসিক আর গরুর মাংসের মেজবানির জন্য সারা দেশেই খ্যাতি রয়েছে চট্টগ্রামের। চট্টগ্রামের মানুষই সবচেয়ে বেশি গরুর মাংস খান। বড় বড় গরু জবাই করে মেজবানির আয়োজন চট্টগ্রামের ঐতিহ্য। কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রামের এই বিপুল পরিমাণ মাংসের চাহিদা পূরনে নেই কোন স্বাস্থ্য সম্মত ব্যবস্থাপনা।

bangal-meat-01

নোংরা আবর্জনা আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গরু জবাই করে কসাইরা নানা প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে মাংস বিক্রি করে। যে গরু জবাই হয় তার কোন স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয় না। গরুর মাংস বলে চালিয়ে দেওয়া হয় মহিসের মাংস। কখনো কখনো অসুস্থ বা মৃত গরুর মাংসও বিক্রি হওয়ার খবর পাওয়া যায়। কিন্তু চট্টগ্রামবাসীকে এমন প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে সুস্থ দেশীয় গরুর মানসম্মত গরুর মাংসের চাহিদা পূরণ করতে চট্টগ্রামের বাজারে আসছে বেঙ্গল মিট।

 

এই বেঙ্গল মিটই বাংলাদেশের একমাত্র বৃহত্তম সর্বাধুনিক মিট প্রসেসিং কারখানা। যেখানে নিজেদের খামারে লালিত গরু, চিকিৎসকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ইসলামীক ফাউন্ডেশনের নিয়ম মেনে হালাল পদ্ধতিতে জবাই করা হয়। জবাইয়ের পর সেই গরু সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে মাত্র ৩ মিনিটে প্রসেসিং করে ফ্রিজিং করে সরবরাহের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
বেঙ্গল মিটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএফএম আসিফ জানান, বাংলাদেশের সব তারকা হোটেলসহ বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেঙ্গল মিটে প্রসেসিং করা গরু, খাসি, হাস, মুরগি ও কবুতরের মাংসের চাহিদা রয়েছে। দীর্ঘদিন পরে হলেও চট্টগ্রামের তরুন শিল্প উদ্যোক্তা সৈয়দ রুম্মান আহাম্মেদের মাধ্যমে বেঙ্গল মিট এবার প্রবেশ করতে যাচ্ছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে। bangal-meat-02

গরুর মাংসের বৃহত্তম ভোক্তা চট্টগ্রামবাসীর হালাল এবং স্বাস্থ্যসম্মত মাংসের চাহিদা পূরনে সক্ষম হবে বেঙ্গল মিট। বেঙ্গল মিট’র সিইও এএফএম আসিফ আরও জানান, বেঙ্গল মিট বাংলাদেশে প্রথম ফ্রেশ ও স্বাস্থ্য সম্মত মাংসের যোগান দিয়ে থাকে। নিজেদের খামারে গরু লালন পালন করে সার্বক্ষনিক চিকিৎসকের তত্বাবধানে রেখে সেই গরু চাহিদা অনুযায়ী জবাই করা হয়।

 
বেঙ্গল মিটের প্রায় একশ বিঘার মতো জমি রয়েছে। এই জমিতে গরুর জন্য স্বাস্থ্যকর ঘাষের চাষ করা হয়। সেই ঘাষ খাইয়ে গরু লালন পালন করা হয়। উৎপাদিত ঘাস প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে লালন-পালনকরা পশুদের খেতে দেওয়া হয়। গরু ও ছাগল বা খাসি বড় করা হয় এখানে। ঘাসের পাশাপাশি ভুট্টার চাষ করা হয় পশুখাদ্য হিসাবে। এখানে পালিত প্রতিটি গরু ও খাসির কানে একটি করে কোড থাকে। এই কোড কম্পিউটারে বিশেষ সফটওয়্যারে দিলেই ওই গরু বা খাসির জন্মবৃত্তান্ত, সুস্থতা অসুস্থতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়।

বেঙ্গল মিটে গরু জবাই প্রক্রিয়াঃ
বেঙ্গল মিটে প্রতিটি গরু জবাই করার আগে নির্দিষ্ট একটি ‘হোল্ডিং’ এলাকাতে রাখা হয়। মানুষের শরীরে অস্ত্রোপচার করার আগে যেমন শুধু পানি খেতে দেওয়া হয় এখানেও জবাই করার আগে একই নিয়ম মানা হয়।

bangal-meat-03
এরমধ্যে জবাই করার আগে একজন পশুচিকিৎসক গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখেন। এই স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা হয়। এর পর একজন দক্ষ আলেম ইসলামী হালাল পদ্ধতিতে সেই গরু জবাই করেন। জবাই হওয়ার পরে আবার সেই গরু ‘পোস্ট মর্টেম’ করা হয়। এই ভাবেই নিশ্চিত করা হয় ক্রেতা কোন সমস্যাযুক্ত বা অসুস্থ গরুর মাংস বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন না। গরু জবাই হয়ে গেলে বেশি সময় উন্মুক্ত রাখলে মাংসে জীবানু আক্রান্ত হতে পারে। এই আশঙ্কা থেকে জবাইয়ের মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই বিশ্বের সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে সেই গরু প্রসেসিং করে ফ্রিজিং করা হয়। জবাই করার সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মনোনীত ব্যক্তি সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকেন হালাল রীতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য।
চট্টগ্রামেই গরুর মাংসের ব্যাপক চাহিদা এই অবস্থায় চট্টগ্রামে বিপুল পরিমাণ হালাল মাংসের নিশ্চয়তা কীভাবে দিবেন জানতে চাইলে বেঙ্গল মিটের চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা সৈয়দ রুম্মান আহাম্মেদ জানান, প্রথমত বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গাইডলাইন মেনে মাংস প্রক্রিয়াজাত করে বেঙ্গল মিট। এই গাইডলাইন প্রস্তুত হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রনালয়, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়, শিল্প প্রতিনিধি ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সমন্বয়ে। bangal-meat-04

এছাড়াও জাকিম মালয়েশিয়া হালাল মাংস উৎপাদনের রীতি অনুসরণ করা হয় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে। গরু জবাই থেকে শুরু করে জবাইকৃত পশুর পোস্টমর্টেম প্রক্রিয়া এমনভাবে সমন্বয় করা হয় যাতে কোন সমস্যা পাওয়া গেলে ওই পশুকে সঙ্গে সঙ্গে প্রোডাকশন লাইন থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়। এই প্রক্রিয়ার আর একটি বিশেষ ও স্বাস্থ্যগত বিষয় হল ভালোমতো রক্ত ঝরানো হয় আর পশুর শরীর থেকে সরিয়ে ফেলা হয় সকল বর্জ্য। সেগুলোকে একেবারে ভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ঠান্ডা ও গরম পানিতে ধুয়ে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে আলাদা করা চামড়া আর অতিরিক্ত মেদও আলাদা করে ফেলা হয়। জবাই করা গরুর মাংস নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় হিমঘরে। পরে এই হিমঘর থেকে বের করে নিয়ে এসে মাংস টুকরা করা ও প্যাকেটজাত করা হয়।

বেঙ্গল মিটের কারিগরি উপদেষ্ঠা অস্ট্রেলিয় প্রকৌশলী ওয়েইন গ্যাস্কেল জানান, গরুর মাংস যে কাটার পরপরই রান্না করলে সবচাইতে ভালো স্বাদ পাওয়া যাবে তা নয়। বেঙ্গল মিটে মাংস কাটাকাটি করা হয় নির্দিষ্ট তাপমাত্রায়। রীতিমতো মাইনাস ডিগ্রিতে চলে এই কাটাকাটির কাজ। জ্যাকেট পরে কর্মীরা কাজ করেন। শরীরে জ্যাকেট আর মাথায় নেট থাকে সবার, যাতে মাংসে কোন অযাচিত কিছু ঢুকে না পড়ে।

এই কারখানায় ঢুকতে গেলে রীতিমতো গামবুট পরে ঢুকতে হয়। সানিটাইজারে ধুতে হবে পায়ের বুট ও হাত। ছোট একটি জলাধারে এমন করে রাখা এই সানিটাইজার যে, কোনভাবেই কেউ না পাড়িয়ে ঢুকতে পারবেন না এই কারখানার ভেতর। আর পশু জবাই অংশের কর্মচারীরা কোন ভাবেই মাংস কাটার ইউনিটে ঢুকতে পারবেন না। বেঙ্গল মিটের পুরো ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন প্রায় ৩ শতাধিক কর্মী।
চট্টগ্রামে বেঙ্গল মিট :
বেঙ্গল মিটের চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা সৈয়দ রুম্মান আহাম্মেদ জানান, বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে বেঙ্গল মিটের বাজার। দেশে গরুর মাংসের বড় বাজার চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো প্রবেশ করছে বেঙ্গল মিট।

bangal-meat-05

চট্টগ্রামের হোটেল রেডিসন, পেনিনসুলাসহ সব তারকা হোটেল বেঙ্গলমিটের প্রধান গ্রাহক হলেও চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ এই বিশুদ্ধ রোগমুক্ত গরুর মাংস খাওয়ার সুযোগ পেতো না। এখন প্রায় অর্ধশতাধিক কর্মীবাহিনী নিয়ে চট্টগ্রামে বেঙ্গল মিট যাত্রা শুরু করছে। এখন একটি মাত্র ফোন করলেই বেঙ্গল মিটের মাংস পৌঁছে যাবে গ্রাহকের দ্বারে। এ ছাড়া নগরীর বৃহত্তম ও সর্বাধুনিক শো-রুমে বিক্রয় ও প্রদর্শন করা হবে বেঙ্গল মিট। চট্টগ্রামে যে কোন মুহুর্তে যে কোন পরিমাণ মাংসের চাহিদা পূরণে সক্ষম বেঙ্গল মিট।
রুম্মান আহাম্মেদ আরও জানান, বাংলাদেশে প্রথাগতভাবে ‘কাট’কে প্রাধান্য দিয়ে মাংস বিক্রির চল কখনও ছিলনা। কাট বলতে পশুর শরীরের বিভিন্ন অংশের মাংসের ধরণ ও এর সঙ্গে স্বাদের তারতম্যকেই ইঙ্গিত করা হয়। ইউরোপ আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশে এই কাটের ভিত্তিতেই মাংস কেনাবেচা হয়। বাংলাদেশে এই প্রচলণ শরু করেছে বেঙ্গল মিট।

 

যেমন স্টেকের মাংসের ধরণ আর বিফ বা মাটন কারি অথবা শিক কাবাবের মাংস আমরা যেভাবে খাই তার কাটার পদ্ধতি ও খাবারে স্বাদ নেওয়ার প্রক্রিয়া একেবারেই আলাদা। বেঙ্গল মিট শুরু থেকেই এই কাজটি করছে। স্টেক তৈরির জন্য এখনো বেঙ্গল মিটের বিকল্প নেই।
রুম্মান আহাম্মেদ বলেন, বেঙ্গল মিট চট্টগ্রামের বাজারে প্রবেশ করায় এখন চট্টগ্রামবাসীকে গরুর মাংসের নামে মহিসের মাংস, দেশীয় গরুর নামে ভারতীয় গরু কিংবা অসুস্থ মৃত গরুর মাংস খেতে হবে না। কসাইদের নানা রকম প্রতারণা থেকেও রক্ষাপাবে চট্টগ্রামবাসী।

রিপোর্ট : রাজীব প্রিন্স

এ এস / জি এম এম / আর এস পি :::

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!