দেশসেরা তামিম ফিরলেন দুর্দান্ত প্রতাপে

সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড, সাতহাজার রানের মাইলফলক

তামিম ইকবালের প্রতিভা নিয়ে কখনো কোন প্রশ্ন উঠেনি। রানের পর রান করে নিজের সামর্থও জানান দেন বেশ আগে। টেস্ট-ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান (টেস্টে মাত্রই মুশফিক অতিক্রম করার আগে) সংগ্রাহক তিনি। সেঞ্চুরির দিক দিয়েও অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে আছেন চট্টগ্রামের বিখ্যাত খান পরিবারের এই উইলোবাজ। কিন্তু তামিমের প্রতি সবার আস্থা, আশা এতোবেশি পরিমাণে যে, পান থেকে চুন খসলেই খবরের শিরোনাম হয়ে যান তিনি। যেমন সিলেটে প্রথম ওয়ানডেতে শ্লথ শুরুর পর দেশজুড়ে সমালোচনার বন্যা। সেটির সাথে যোগ হয়েছে গত ১৯ মাসে (২৩ ইনিংসে) ওয়ানডে কোন সেঞ্চুরির দেখা না পাওয়ায়। দ্বিতীয় ম্যাচের আগেরদিন তাই তামিমের হয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে ব্যাট করতে হয়েছে ব্যাটিং কোচ ম্যাকেঞ্জিকে। সেখানে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন তামিমকে নিয়ে তারা (দলের ম্যানেজমেন্ট) উদ্বিগ্ন নন, রয়েছে অগাধ আস্থা। ব্যাটিং কোচ ও দলের সবার সেই আস্থার প্রতিদান দিতে সময় বেশি নেননি তামিম ইকবাল। পরের দিনই (আজ) দ্বিতীয় ওয়ানডেতে আবার চেনালেন তামিমের জাত। জানালেন ফুরিয়ে জাননি তিনি, ভোলেননি আক্রমণাত্মক ক্রিকেট।

৯৯ রানে অপরাজিত থাকা তামিম ইকবাল শন উইলিয়ামসের অফস্ট্যাম্পের বাইরের বলটি সামনে ঠেলেই দিলেন ভোঁ-দৌড়, দুই রান। সেঞ্চুরি পূর্ণ হওয়ার পর কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন তামিম। স্বস্তি, তৃপ্তি ফুটে উঠছিল শরীরী ভাষায়। যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন! এমনটা হওয়ারই কথা, কত কিছুই যে জয় করতে হলো দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যানটিকে। বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে দুই সেঞ্চুরি করে বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে দুই ফিফটি পেয়েছিলেন তামিম ইকবাল। তামিমের সমালোচনায় জর্জরিত হওয়ার গল্পটা শুরু বিশ্বকাপ থেকে। তারপর দিন যত গড়িয়েছে অভিজ্ঞ ক্রিকেটারকে ততোই সমালোচনায় বিষিয়ে উঠতে হয়েছে।

রান যে একেবারেই পাচ্ছিলেন না তেমনটা নয়। পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তামিম। বঙ্গবন্ধু বিপিএলে ৩৮ দশমিক ৬০ গড়ে ৩৯৬ রান করার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে ট্রিপল সেঞ্চুরি পেয়েছেন। কিন্তু রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে স্ট্রাইকরেট প্রত্যাশা মতো হচ্ছিল না। ইনিংসের শুরুর দিকে বড্ডই ধীর গতিতে ব্যাটিং করছিলেন। তামিমকে ক্ষতবিক্ষত হতে হচ্ছিল সেটা নিয়েই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘বাদ দেওয়া উচিত’ সমালোচনাই শুধু নয়, বাঁহাতি ওপেনারের কাঁধে চেপে বসে টিম ম্যানেজমেন্টও। একদিন আগে বাংলাদেশর ব্যাটিং কোচ নেইল ম্যাকেঞ্জি সরাসরিই বলছিলেন, টিম ম্যাানেজমেন্ট চায় ইনিংসের শুরুতে আরও রান তুলুক তামিম।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে বাজে একটা অভিজ্ঞতা হলো হয়তো এসবের জেরেই। ২৪ রানে আউট হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরছিলেন তামিম। গ্যালারী থেকে তাকে অশ্লিল ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন এক দর্শক। পরে বিষয়টি থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। অন্য কেউ হলে এতো কিছুর চাপে হয়তো ভেঙে পড়তেন। তামিম পড়েননি, ঘুরে দাঁড়ালেন দুর্দান্তভাবে।

বাংলাদেশের পক্ষে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান
১. তামিম ইকবাল – ২০৬ ম্যাচে ৭০২১* রান, সর্বোচ্চ ১৫৮
২. সাকিব আল হাসান – ২০৬ ম্যাচে ৫৩২৩ রান, সর্বোচ্চ ১৩৪
৩. মুশফিকুর রহীম – ২১৮ ম্যাচে ৬১৭৪ রান, সর্বোচ্চ ১৪৪
৪. মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ – ১৮৭ ম্যাচে ৪০২৬ রান, সর্বোচ্চ ১২৮
৫. মোহাম্মদ আশরাফুল – ১৭৫ ম্যাচে ৩৪৬৮ রান, সর্বোচ্চ ১০৯

‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পারমানেন্ট’ ক্রিকেটের চিরাচরিত এই কথাটা বারবার বলে এসেছেন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে ‘ক্লাস’টা মঙ্গলবার (৩ মার্চ) দেখালেন তামিম। পাহাড়সম চাপ কাঁধে নিয়ে এদিন শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক খেলেছেন তামিম। ফিফটি ছুঁতেই চার হাঁকিয়েছেন দশটি। ইনিংসের শুরুতে ধীর গতিতে ব্যাটিং করার কারণে মাসের পর মাস সমালোচনায় জর্জরিত হওয়া তামিম হাফ সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন ৪২ বলে। এমন আক্রমণাত্মক ফিফটির পর তার বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারেনি জিম্বাবুয়ের বোলিং ডিপার্টমেন্ট। পরের পঞ্চাশ করতে খেলেছেন ৬৪ বল।

ওয়ানডেতে তামিম সর্বশেষ সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন ২০১৮ সালের জুলাইয়ে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। তারপর ২৩ ইনিংস পর তিন অঙ্ক ছুঁলেন বাঁহাতি এই ওপেনার। ব্যাটিং কোচ নেইল ম্যাকেঞ্জি বলছিলেন, বড় একটা ইনিংস পেলেই ছন্দে ফিরবেন তামিম। শেষ পর্যন্ত সেটিই সত্যিতে পরিণত হলো।

২০০৯ সালে বুলাওয়েতে এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই ১৫৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তামিম। এটিই ছিল এতদিন পর্যন্ত তার এবং বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ। এবার নিজেকেই ছাড়িয়ে গেলেন তামিম। করলেন ১৫৮ রান, মাত্র ১৩৬ বলের ইনিংসটি সাজানো ছিল ২০টি চার ও ৩টি ছয়ে। গত কয়েকদিন ধরে তার খেলার ধরণ আর আউট নিয়ে সমালোচনা হচ্ছিল ভীষণ। তামিম মাঠেই জবাব দিলেন, এমনই জবাব; সমালোচকদের মুখ খোলার উপায়ই রাখলেন না। ১০৬ বলে সেঞ্চুরি, ১৩২ বলে ১৫০। অর্থাৎ সেঞ্চুরির পরের ফিফটি তুলে নিতে তামিম খরচ করেছেন মোটে ২৬টি বল। নিজের দিনে তিনি কি করতে পারেন দেখিয়ে দিলেন সবাইকে।

সাত হাজারে বাংলাদেশের প্রথম তামিম
ভক্ত-সমর্থকদের আশা ছিলো প্রথম ম্যাচেই পৌঁছে যাবেন কাঙ্খিত অর্জনে, ছুঁয়ে ফেলবেন সাত হাজার রানের মাইলফলক; কিন্তু রোববারের ম্যাচে রয়ে-সয়ে শুরুর পরেও নিজের ইনিংস বড় করতে পারেননি তামিম ইকবাল। আউট হয়েছিলেন ৪৩ বলে ২৪ রান করে।
সব সমালোচনার জবাব আজ নিজের মতো করে খেলেই দিয়েছেন তামিম। যার সুবাদে পৌঁছে গেছেন সাত হাজার রানের মাইলফলকে। সিরিজ শুরুর আগে এ ক্লাবে পৌঁছাতে তামিমের দরকার ছিলো ১০৮ রান, প্রথম ম্যাচে ২৪ রান করায় বাকি থাকে আরও ৮৪ রান। সেটিই করলেন তামিম। ডোনাল্ড তিরিপানোর করা অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলে আলতো ছোঁয়ায় থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে ৮১ থেকে ৮৫ রানে পৌঁছে যান তামিম। সঙ্গে সঙ্গে পূরণ হয় তার ৭০০০ ওয়ানডে রান। বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম এবং বিশ্ব ক্রিকেটের ৪২তম ব্যাটসম্যান হিসেবে এ মাইলফলকে পৌঁছলেন তামিম।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!