দেনমোহরের ষোলো আনাই ফাঁকি!

tumblr_m2s19fOOvd1ru02zqo1_500

 

বিবাহিত জীবনের সাত বছর পর এক সন্তানের মা সোনিয়ার (ছদ্মনাম) স্বামী রহমান (পুরো নাম নয়) তাদের বৈবাহিক সম্পর্কে বিচ্ছেদের উদ্যোগ নেন। সোনিয়ার আইনজীবী জানান দেনমোহরের ৩ লাখ টাকা দাবি করতে হলে কাবিননামার অনুলিপি লাগবে। কাবিন যে লাগতে পারে, বিবাহিত জীবনে কখনও সেটা ভাবেননি সোনিয়া। খোঁজ করে সাত বছরের পুরনো কাবিন সংগ্রহ করার পর আইনজীবী দেখেন কাবিননামায় মোহরানার তিন লাখ টাকার পুরোটাই উসুল (পরিশোধ) লেখা আছে।

সোনিয়া আইনজীবীদের জানান, বিয়ের সময় তাকে ৩০ হাজার টাকার গয়না ছাড়া কিছুই দেয়নি ছেলেপক্ষ। অথচ পুরোটা উসুল লেখা থাকায় সোনিয়া তার বিচ্ছেদের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তার কোনও অর্থ দাবি করতে পারবেন না। আইনজীবীরা বলছেন তারা প্রায়শই এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে থাকেন। বিয়ের সময় উভয় পরিবার ও পাত্রপাত্রী আবেগের মধ্যে থাকে বলে কাবিননামায় কী লেখা হচ্ছে সেটা নিয়ে একেবারেই সচেতন থাকে না। এমনকি দেনমোহর কেন তার অধিকার এবং কিভাবে সেই অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে সেটাও তারা ভেবে দেখে না। যখন দরকার হয় তখন দেখা যায় দেনমোহরের ষোলো আনাই ফাঁকি।

ঢাকার একাধিক কাজী অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিয়ের সংখ্যা আর কাবিন সংগ্রহের সংখ্যায় আকাশ পাতাল তফাৎ। ‘পেশাদার নিরাপত্তা’র কারণ দেখিয়ে সংখ্যাটা জানাননি তারা। যদিও তাদের সহযোগীরা বলেছেন এ ধরনের কোনও হিসাব চাইলেও তারা দিতে পারবেন না। কিন্তু যেসব বিয়ে তারা দেন তার মধ্যে খুব কম পরিবারই নিকাহনামার অনুলিপি নিতে আসেন।

কাজী আমির হোসেন বলেন, সাধারণত প্রেম করে বিয়ে করতে আসে কাজী অফিসে। যারা বিয়ে করেন পরে আবারও তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন অভিভাবকরা। ফলে আগের কাবিননামা তারা নেয় না। তবে দ্বিতীয়বারের কাবিনটাও নেয় কিনা সন্দেহ আছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তেজগাঁও এলাকার আরেক কাজী বলেন, শিক্ষিতদের ভেতর কাবিননামা রাখার হার কম। তবে বিদেশে যেতে বা অফিসের কাজে যদি দরকার হয় তখন তারা কপি চাইতে আসেন। তাছাড়া বছরের পর বছর আমাদের কাছে পড়ে থাকে।

সালমা (ছদ্মনাম) আগারগাঁও বিএনপি বস্তি এলাকায় থাকেন। ৫ বছরের সন্তানকে পাশের বাড়িতে রেখে বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। স্বামী আরও দুই বিয়ে করেছে। কিন্তু সালমাকে কোনও আর্থিক সহায়তা দেয়নি। কাবিননামার কথা জিজ্ঞেস করতেই নাজমাসহ আশোপাশের ৫ ঘরের মেয়েরা মুখ টিপে হাসে আর বলে ‘আমাদের মতো ঘরে মওলানা সাহেবকে ডাইকা খাওয়াইয়া কিছু টাকা দিয়ে বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থাই বেশি। ব্যাটারা (স্বামী) সাথে না থাকলে কি আপনারে খাওয়াইবনি?’ খোরপোশ বা কাবিন থাকলেও দেনমোহরের প্রাপ্য নিয়ে তারা একেবারেই চিন্তিত না।

উল্লেখ্য, মুসলিম আইনে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন না করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রেজিস্ট্রেশন না করলে ২ বছর বিনাশ্রম কারাদ- ও ৩ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দ- হতে পারে।

যেসব বিয়েতে কাবিনের প্রচলন আছে তাদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগই বিয়ের সময় নিকাহনামা লিখতে গিয়ে দেনদরবার করলে ‘বিচ্ছেদের কথা বলতে নেই শুভকাজের সময়’, ‘কী দরকার এসব বিস্তারিত লেখা’, ‘আপনাদেরই তো ছেলে’, ‘আমরা কি পালিয়ে যাচ্ছি!’, ‘সম্পর্ক কি একদিনের!’ এসব কথা বলে মেয়ের অনুপস্থিতিতে পরিবারের বড়রা একটা নিকাহনামা তৈরি করেন। ৩ লাখ টাকা দেনমোহর ধরা হলে ৫০ হাজার টাকার গহনা দিয়ে পুরোটাই উসুল লিখিয়ে নিয়ে অধিকারবঞ্চিত করেই জীবন শুরু করানো হচ্ছে মেয়েটিকে।

পারিবারিক পরিসরে কেবল অসচেতনতার কারণেই এসব হচ্ছে বলে তেমন কোনও পরিবর্তন আনাও সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন মানবাধিকার নেত্রী আইনজীবী এলিনা খান। তিনি বলেন, বিবাহ সম্পর্কে দেনমোহর মেয়েটির অধিকার। কিন্তু সেখানে কিভাবে তাকে ফাঁকিতে ফেলা যায় তা নিয়ে অভিভাবকদের অঙ্ক কষার হার তথাকথিত শিক্ষিত সমাজেই বেশি। তিনি এও বলেন, ‘যারা বিচ্ছেদের ঘটনার পর মামলা করতে আগ্রহী হন তাদেরও দেনমোহর বুঝে পাওয়ার হার খুবই কম, তবে মামলায় রায়টা পক্ষেই পেয়ে থাকে।’

আইন ও শালিস কেন্দ্র জানাচ্ছে একই তথ্য। প্রতিষ্ঠানটি জানাল, দেনমোহরের বিষয়ে যত মামলা সেগুলো পারিবারিক আদালতে নিষ্পত্তি হলেও এক্সিকিউশনের মামলা ঝুলে তাকে বছরের পর বছর। এমনকি কখনও কখনও দশকও পেরিয়ে যায়।

প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া ও র‌্যাপিড রেসপন্স ইউনিটের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নিনা গোস্বামী বলেন, ‘মামলার রায় হওয়ার পর এসব ক্ষেত্রে এক্সিকিউশনের জন্য আরেকটি মামলা করতে হয়। সেক্ষেত্রে অপর পক্ষকে খুঁজে পাওয়া যায় না।’ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘যখন খুঁজে পাওয়া যায় না তখন তাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়। কিন্তু থানা সেটাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে না।’

নিনা আরও বলেন, ‘ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে তারা যত আগ্রহী থাকে, পারিবারিক আদালতের মামলায় তাদের আগ্রহ ততটা থাকে না।’ নিনা তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘শিক্ষিত মেয়েরা কাবিন তোলে না, এমনকি এমন ক্লায়েন্টও আসেন যারা আসলে জানেনই না কমিউনিটি সেন্টারে ঠিক কোন এলাকার কাজী এসে তাদের বিয়ে পড়িয়ে গেছেন।’ তিনি বলেন, কেবলমাত্র প্রি-ট্রায়াল ধাপে বিচারকের সামনে যখন পরস্পরের সমঝোতায় সিদ্ধান্ত হয় তখন দেনমোহর যতটুকু লেখা থাকে সেটাই পায়।’ বাংলাট্রিবিউন

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!