‘দুর্নীতি’ ঢাকতে চট্টগ্রাম রেডক্রিসেন্টের তড়িঘড়ি এজিএম, চেয়ারম্যানই কিছু জানেন না

ভাইস চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে উঠল দুর্নীতির অভিযোগ

একের পর এক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠছিল রেডক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট নিয়ে। এবার সেখানে ঘটেছে আরেক কাণ্ড। খোদ চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে বোর্ড সদস্য, এমনকি সাধারণ সদস্যদেরও না জানিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করা হয়েছে অনেকটা চুপিসারে।

দুর্নীতির অভিযোগ এড়াতে রেডক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের ভাইস চেয়ারম্যান এই কাণ্ডটি করেছেন— এমন অভিযোগ এসেছে সাধারণ সদস্যদের কাছ থেকে। তারা বলছেন, নগরীর বহদ্দারহাটের আর বি কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত কথিত সেই এজিএমে ১১০০ জন সদস্য উপস্থিত থাকার কথা দাবি করা হলেও সেখানে উপস্থিত ছিলেন বড়জোর ১০০-১৫০ জন। যা ওই কমিউনিটি সেন্টারের সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।

সাধারণ সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, নিয়ম অনুযায়ী এজিএমের আগে পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে কমিটির সভা ডাকা বাধ্যতামূলক। অথচ কোনো সভাই হয়নি। এমনকি ২৬ মাস আদতে কোনো সভাই হয়নি। বেশ কিছুদিন আগে মিটিং করা হয়েছিল শুধু একবার।

জানা গেছে, গত বুধবার (২ ডিসেম্বর) হঠাৎ করেই রেডক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের খবর পান সাধারণ সদস্যরা। খোদ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এমএ সালাম জানিয়েছেন, তিনি এজিএমের কোনো খবরই জানতেন না। শীর্ষ সংগঠকদেরও অনেকে জানতেন না বিষয়টি। তবে যার বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর— রেডক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের সেই ভাইস চেয়ারম্যান শেখ শফিউল আজম জানান, চিঠি দিয়ে চেয়ারম্যানসহ সবাইকে এজিএম অনুষ্ঠিত হবে— এটি জানানো হয়েছিল।

চেয়ারম্যানসহ একাধিক বোর্ড সদস্যকে না জানিয়েই রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
চেয়ারম্যানসহ একাধিক বোর্ড সদস্যকে না জানিয়েই রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা যায়, রেডক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, সেক্রেটারি ছাড়াও সদস্য রয়েছেন ৮ জন।

সংগঠনটির চট্টগ্রাম ইউনিটের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এমএ সালাম ছাড়াও বোর্ড সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা জসীম উদ্দিন শাহ, বেদারুল আলম চৌধুরী বেদার, দোলন মজুমদার, অ্যাডভোকেট সাইফুন নাহারসহ আরও অনেকেই অভিযোগ করেছেন, বুধবার বহদ্দারহাটের আর বি কমিউনিটি সেন্টারে এজিএম অনুষ্ঠিত হবে— এটি জানানো হয়নি তাদের। চেয়ারম্যান ও একাধিক বোর্ড সদস্যকে না জানিয়ে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের ৪৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করা হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।

বোর্ড সদস্য ও উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা জসীম উদ্দিন শাহ বলেন, ‘এজিএম অনুষ্ঠিত হবে এটা আমার জানা ছিল না। কারণ আমাকে কেউ জানায়নি।’

বোর্ড সদস্য বেদারুল আলম চৌধুরী জানান, ‘জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে তিনজনের নাম পাঠাবেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে। অথচ চেয়ারম্যান কিছুই জানেন না। গত ২৬ মাস কোনো মিটিং হয়নি। বেশ কিছুদিন আগে মিটিং করা হয়েছিল মাত্র একবার।’

তিনি বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে জেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান সারাদেশে পদাধিকার বলে চেয়ারম্যান। কিন্ত চট্টগ্রামে গত আট বছরেও ওনাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দেননি ডা. শফিউল আজম। কেন্দ্রীয় রেডক্রিসেন্টের বোর্ড মেম্বারের দাপটে তিনি এটাকে কুক্ষিগত করে রেখেছেন। এখানে গত আড়াই বছরে কোনো ইসি কমিটির সভা করা হয়নি।’

বেদারুল আলম চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, ‘শেখ শফিউল আজম ইচ্ছেমতো টাকা লুটপাট করেছেন। প্রতিষ্ঠানের ডাক্তার-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয় দুই-তিন মাস পর একমাসের। কোভিডের সময় তিন হাজারেরও বেশি পরিবারের জন্য ত্রাণ এলেও তা সুষ্ঠুভাবে বিলি হয়নি। শফিউল আজম ইচ্ছেমতো বিলিবন্টন করেছেন। বছরের পর বছর ধরে জেমিসন রেডক্রিসেন্টে মাতৃসদন নিয়েও দুর্নীতি করে যাচ্ছেন তিনি।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সংগঠনের চেয়ারম্যান এমএ সালাম বলেন, ‘আমি রেডক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের চেয়ারম্যান। আমাকে ছাড়া কিভাবে এজিএম অনুষ্ঠিত হল— এটা আমার বোধগম্য নয়। আমি জানতামই না বুধবার এজিএম অনুষ্ঠিত হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘রেডক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট নিয়ে অভিযোগের পাহাড় রয়েছ। ভাইস চেয়ারম্যান দোষারোপ করছে সেক্রেটারিকে। সেক্রেটারি সদস্যদের। সদস্যরা আবার ভাইস চেয়ারম্যানকে। আর এ অভিযোগ-অনুযোগে এই সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।’

কিন্তু এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন শেখ শফিউল আজম। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে তিনি দাবি করেন, ‘চেয়ারম্যানকে এজিএমের কথা জানানো হয়েছিল। তিনি কোভিডে আক্রান্ত ছিলেন। কোভিড থেকে মুক্তি পেলেও পরবর্তীতে তার শরীরে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তাকে এজিএমের বিষয়ে জানালে তিনি জানান, তার শারীরিক অবস্থা ভালো না। তিনি এজিএমে উপস্থিত হতে পারবেন না। তাই আমি ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে যা ভালো বুঝি তাই যেন করি।’

কিন্তু বাকি সদস্যদের কেন এজিএমের বিষয়ে জানানো হল না— এমন প্রশ্নের উত্তরে রেডক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের ভাইস চেয়ারম্যান শেখ শফিউল আজম দাবি করেন, ‘চিঠি দিয়ে সবাইকে জানানো হয়েছে। কেউ যদি চিঠি পেয়েও না আসে সেটা তার ব্যর্থতা। আমার না। গত অক্টোবরে মিটিং করে ২ ডিসেম্বর এজিএম অনুষ্ঠিত হবে— তা জানানো হয়েছিল সব সদস্যকে। তাই চেয়ারম্যান ও একাধিক বোর্ড সদস্যকে না জানিয়ে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের এজিএম করা হয়েছে—এ অভিযোগ ডাহা মিথ্যা।’

শেখ শফিউল আজম জানান, ‘এজিএমে বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটির সেক্রেটারি নুরুল আনোয়ার চৌধুরী বাহারসহ শতাধিক আজীবন সদস্য যোগ দিয়েছেন। আমার প্রশ্ন এসব সদস্য কিভাবে এজিএম অনুষ্ঠিত হওয়ার খবর পেয়েছিল?’

তবে শফিউল আজমের এই দাবি খণ্ডন করে বোর্ড সদস্য অ্যাডভোকেট সাইফুন নাহার বলেন, ‘শেখ শফিউল আজমের পছন্দের লোকেরাই তার সাথে ছিলেন— অনিয়ম-দুর্নীতিতে যাদের সঙ্গে তার যোগসাজশ রয়েছে।’

আইএমই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!