দুর্দিনের নেতারাই অবহেলার শিকার সাতকানিয়া আওয়ামী লীগে, নেপথ্যে ব্যক্তিবিরোধ ও পদবাণিজ্য

১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন মাঈনুদ্দিন হাছান চৌধুরী। ১৯৯৬ সালে দলীয় প্রতীকে জামায়াত অধ্যুষিত সাতকানিয়া-লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম-১৪ আসন) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচন করেন। কিন্তু দল যখন ক্ষমতায়, তখন সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভায়ও স্থান হচ্ছে না তার। এমন অবহেলার তালিকায় রয়েছেন দলের প্রবীণ নেতারা। এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে। তারা বলছেন, ব্যক্তিগত বিরোধ ও পদবাণিজ্যের জের ধরে দলীয় কর্মসূচিতে উপেক্ষার শিকার হচ্ছেন— এমন আছেন আরও অনেকেই।

তবে সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কুতুব উদ্দিন চৌধুরী বলছেন ভিন্ন কথা। তার দাবি, মঈনুদ্দিন হাছান চৌধুরীকে দাওয়াত দেওয়া হলেও বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচিতে তিনি আসেন না।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নুরুল আবছার চৌধুরী। নব্বইয়ের দশকে ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। এখন দল যখন ক্ষমতায়, সাতকানিয়া উপজেলার আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচিতেও অবহেলিত তিনি। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ২৬ আগস্ট আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল করে সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ। সেখানেও অতিথির তালিকায় তাদের স্থান হয়নি তার।

সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ইউনিয়নে একাধিক ওয়ার্ড সম্মেলন হয়েছে ইতিমধ্যে। অথচ মাঈনুদ্দিন হাছান চৌধুরী ও নুরুল আবছার চৌধুরী সোনাকানিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা হলেও তাদেরকে সম্মেলনে দাওয়াত দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সোনাকানিয়া ইউনিয়নে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে সাবেক এলডিপি নেতাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে কুতুব উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন নুরুল আবছার চৌধুরী। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় সভায়ও মফিজুর রহমানসহ উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন তিনি। এতে বিরোধ আরও প্রকাশ্য হয়। অন্যদিকে সোনাকানিয়া ইউনিয়নে মাঈনুদ্দিন হাছান চৌধুরীর পৈতৃক ভিটা নিয়ে বিরোধ তৈরি হয় কুতুব উদ্দিনের সঙ্গে।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ব্যক্তিগত বিরোধ ও পদবাণিজ্যের জের ধরে দলীয় কর্মসূচিতে উপেক্ষার শিকার হচ্ছেন— এমন নেতা আছেন আরও অনেকেই।

তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, অনেকে সুদিনে এসে দল ভারী করছেন। দুঃসময়ে যারা দলের সাথে ছিলেন আজ তারাই অবহেলিত। সাতকানিয়ায় জামায়াতের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে মঈনুদ্দিন হাছান চৌধুরী আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনে সারা দেশে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এলাকায় স্বচ্ছ রাজনৈতিক নেতা হিসেবেও পরিচিত তিনি।

নেতাকর্মীরা বলছেন, দলীয় কাজে তাদের মতো নেতাদের সম্পৃক্ত করতে না পারাটা দুঃখজনক। একসময় নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করলে হেরে যাবেন সেই ভয়ে বড় নেতারা নির্বাচন করতেন না। অথচ সাহস করে যারা সে সময় নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেছেন, তারাই আজ অবহেলিত।

সর্বশেষ আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর সাতকানিয়া পৌরসভা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সম্মেলনের ব্যানারেও অতিথিদের যেসব নাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে, সেখানে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক এবং একাধিক সদস্যের নাম থাকলেও প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের স্থান হয়নি।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার জানা মতে উপজেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভায় মাঈনুদ্দিন হাছান চৌধুরীকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। তিনি (মাঈনুদ্দিন হাছান চৌধুরী) নিজেই আসবেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। জেলার কর্মসূচিতেও আসলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। পটিয়ায় যে জনসভায় নেত্রী (শেখ হাসিনা) এসেছিলেন সেখানেও তিনি এসেছেন।’

সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কুতুব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার সামনেই আমাদের সভাপতি ওনাকে (মাঈনুদ্দিন হাছান চৌধুরী) সম্মেলনের দাওয়াত দিয়েছেন। তিনি আসেননি।’

অতিথিদের তালিকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কারেন্ট নেতাদের নাম ব্যানারে দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। তিনি সাবেক নেতা। তাই তার নাম দেওয়ার সুযোগ হয়নি।’

দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নুরুল আবছার চৌধুরীকে অতিথি তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে কুতুব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘তার (নুরুল আবছার চৌধুরী) ভাতিজা নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছেন। তিনি নিজেও নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারণা করেছেন। নির্বাচনে এক নম্বর ওয়ার্ডের নৌকার এজেন্টকে বের করে দিয়েছেন তিনি। হাইকমান্ডে নির্দেশনা আছে, নৌকার বিরোধীদের দলীয় কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত না করতে।

কুতুব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সোনাকানিয়া ইউনিয়নের ৪,৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের সম্মেলনের সময় তিনি আলাদা ভেন্যুতে ১,২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের সম্মেলন করবে বলে নিজের মোবাইল থেকে নেতাকর্মীদের মেসেজ দেন। তার সম্মেলন আহবান করার ক্ষমতা নাই। এমনকি আমি চাইলেও পারবো না। ওয়ার্ডের সম্মেলন করার ক্ষমতা আছে ইউনিয়ন সভাপতি, সম্পাদকের। এসব কারণে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাকে বহিষ্কার করার দাবি উঠেছে।’

তবে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক নুরুল আবছার চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একতরফা পদবাণিজ্য করতেই আমাদেরকে দলীয় কর্মসূচিতে দাওয়াত দিচ্ছে না। তার অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলি, তাই সে এমনটা করছেন। ২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের পক্ষে ভোট করার কেউ ছিল না। আমি দলের হয়ে ভোট করেছি। তখন তারা কোথায় ছিল? ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমি নৌকার বিপক্ষে ভোট করিনি। সোনাকানিয়ায় এলডিপির নেতাকে টাকার বিনিময়ে নৌকায় মনোনয়ন দিয়েছে সে (কুতুব উদ্দিন চৌধুরী)। এর আগে জামায়াত নেতাকে মনোনয়ন দিয়েছিল সে। সে নিজে ধর্মপুর, চরতি ও নলুয়া ইউনিয়নে নৌকার পক্ষে কাজ করেনি। এটা সবাই জানে।’

তিনি বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় চ্যালেঞ্জ করেছি, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগ যে টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন বাণিজ্য করেনি, সেটা কোরআন ধরে শপথ করতে হবে। তারা সেটি করতে পারেনি। এই কথা বলার পর থেকেই তারা আমার সবাই বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কুতুব উদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের নির্ধারিত উপজেলা সাংগঠনিক সমন্বয় টিমের সদস্যদের মধ্যে যাদের নাম রাখা হয়নি, সম্মেলনের প্রচারণায়ও স্বাভাবিকভাবেই তাদের নাম আসেনি।’

পদবাণিজ্যের অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সোনাকানিয়ার যে চেয়ারম্যানকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, সেই চেয়ারম্যান ১৯৯১ থেকে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। একটা ছবিকে কেন্দ্র করে তাকে এলডিপি বানানোর চেষ্টা অপরাজনীতি ছাড়া আর কিছু নয়। পদবাণিজ্য বা মনোনয়ন বাণিজ্যের কোন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে আমি নিজেই অব্যাহতি নেবো।’

কুতুব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘মাইনুদ্দিন হাসান চৌধুরী উপজেলা আওয়ামী লীগের দু একটি অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগত কারণে উপস্থিত হতে পারবেন না বলাতে হয়ত পরবর্তী অনুষ্ঠানে ভুলবশত উনাকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। আর উনার সাথে পারিবারিক বিরোধের বিষয়টি সত্য নয়। আমাদের উভয় পরিবারের মধ্যে আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রয়েছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!