দুর্দিনের ছাত্রনেতা অভাবের জীবন থেকে নিলেন চিরবিদায়

একসময় তার নামডাক ছিল বেশ। দুর্দিনে আগলে রাখতেন দলকে। যখন পাতি নেতারাও ধুলো উড়িয়ে গাড়ি হাঁকাচ্ছেন, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসিম উদ্দিন হল শাখা ছাত্রলীগের এই সাবেক সভাপতির পরিবার নিয়ে অভাব-অনটনে দিন কাটিয়ে যাচ্ছিলেন ভরা জীবন তার। তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মোতাহার হোসেন রানা।

এখন আর তাকে অর্ধাহারে-অনাহারে কাটাতে হবে না। সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নিয়ে শুক্রবার (১ জানুয়ারি) দুপুর সাড়ে ১২টায় চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের নিজ কুঁড়েঘরে মানুষটি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন চিরতরে।

মোতাহার হোসেন রানা ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ছিলেন মিরসরাই থানা ছাত্রলীগের সভাপতিও। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাকে দেখা যেতো মিছিলের পুরোভাগে।

দুর্দিনের এই ত্যাগী নেতা নিজে একসময় অনেক করেছেন ছাত্রলীগের জন্য। কিন্তু টাকা-পয়সার দিকে কখনও তাকাননি। দলবাজি করেননি কখনও। সে কারণে তার দাপটও ছিল না। কেউ দয়া করে ৫০-১০০ টাকা দিলে সেটা নিয়ে অর্ধাহার-অনাহারে পরিবার নিয়ে দিন কাটাতেন।

গত বছরের ১৬ নভেম্বর মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের একটি ছবি আলোচনার জন্ম দেয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন একসময়ের মাঠকাঁপানো এই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোতাহার হোসেন রানা। সভামঞ্চে তারই হাতে গড়া কর্মী, সহযোদ্ধাদের অনেকে থাকলেও মোতাহার ছিলেন দর্শকসারির এক কোণায়। নতুন-পুরনো নেতাকর্মীদের ভিড়ে জনতার সারিতে একাকী বসে ছিলেন দুর্দিনের ত্যাগী এই নেতা। ময়লা ছেঁড়া শার্টে উদভ্রান্ত চোখের মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না এই লোকটিই একসময় ছাত্রলীগের দাপুটে নেতা ছিলেন।

না, মৃত্যুর খবর পেয়ে একসময়ের দাপুটে ছাত্রলীগ নেতার কুঁড়েঘরের সামনে নেতাকর্মীর ঢল নামেনি।
না, মৃত্যুর খবর পেয়ে একসময়ের দাপুটে ছাত্রলীগ নেতার কুঁড়েঘরের সামনে নেতাকর্মীর ঢল নামেনি।

মোতাহের হোসেন রানার নিজের অবশ্য আক্ষেপ ছিল না এ নিয়ে। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে সে সময় তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। আওয়ামী লীগ আমার রক্তে মিশে আছে। একটা সময় রাজনীতিতে ছিলাম। কতজনকে কতো সাহায্য সহযোগিতাও করেছি। কিন্তু আমার আজকের এই পরিণতি শুধু আমার তকদিরের জন্য। আওয়ামী লীগের সভায় আমার অবস্থান আমার তকদির ছাড়া কিছুই না। কেউ দায়ী নয় আমার এ অবস্থার জন্য। প্রধানমন্ত্রী আমাকে সম্মান দিয়ে কিছু ভাতা দেন। প্রধানমন্ত্রী যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন ভাতাগুলো পাবো। তবে এ ভাতা দিয়ে পরিবার চালাতে পারি না।’

কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘আপা (প্রধানমন্ত্রী) আমার পরিবার নিয়ে চলতে খুব কষ্ট হয়। ৬ ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, আল্লাহ যে কেমনে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমিও জানি না। আপা আমি এমএ পাশ করেছি, আপনি আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলে আপনার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ থাকবো সারাজীবন।’

মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া এলাকায় মোতাহের হোসেন রানার বাড়ি। স্ত্রী ও ৬ ছেলেমেয়ে নিয়ে ছিল তার পরিবার। তিন ছেলে তিন মেয়ে পড়াশোনা করছেন। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সামান্য ভাতা পান মোতাহের হোসেন রানা। অল্প ওই ভাতায় চলে না তার পরিবারের সদস্যদের খাওয়া-দাওয়া ও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ। তবে অর্থকষ্টে থাকলেও রাজনীতির প্রতি নেই তার কোনো ক্ষোভ বা আক্ষেপ।

সরকার ও রাজনীতিবিদদের প্রতি কোনো আক্ষেপ আছে কিনা জানতে চাইলে মোতাহের হোসেন রানা বললেন, ‘কী বলেন? আমার ছাত্রলীগ, আমার আওয়ামীলীগ, আমার মাননীয় নেত্রী অনেক বছর পরে ক্ষমতায় এসেছেন এর চেয়ে সুখের আর কী হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আমি চলি। আওয়ামী লীগ আমার রক্তে। কার প্রতি আমি ক্ষোভ প্রকাশ করবো? কারও প্রতি আমার কোনো দুঃখ নেই। যার ইচ্ছে হবে সে সাহায্য করবে। আমার ভাগ্য তো আমাকেই ভয়ে বেড়াতে হবে। কেন আমি অন্য কাউকে দুষবো। সবসময় আমার বঙ্গবন্ধুর জয় হোক এ কামনা করি।’

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সাবেক সহ-সম্পাদক নওশাদ মাহমুদ রানা বলেন, ‘১৯৮৫ সাল থেকে রানা ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। রানা ভাই ছিলেন মিরসরাই থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য। রাজনীতিতে উনার মতো ত্যাগী নেতা আমি আর একজনকেও দেখিনি। যেকোনো ঝামেলায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি, নিজের চিন্তা করেননি কখনো। শুধু দিয়ে গেছেন, ওনার যা ছিলো। অথচ উদভ্রান্ত, ময়লা ছেঁড়া শার্ট পরিহিত ও আশাহীন চোখে তাকিয়ে থাকা এ মানুষটিকে বড়ই অসহায়ভাবে বেঁচে থাকতে হয়েছে আমাদের সমাজে। বর্তমান রাজনীতিতে অর্থ-বিত্ত না থাকলে তার দাম নেই। এখন তো রাজনীতিও নেই। রাজনীতিকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে কিছু মানুষ টাকা উপার্জনের পথ বের করেছে মাত্র।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!