দুবাইয়ের মামলায় চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন, টাকা নিয়েও বানায়নি জাহাজ

৪৩ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে মামলা

চট্টগ্রামভিত্তিক জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিনের বিরুদ্ধে ৪৩ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেছে দুবাইভিত্তিক জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আল-রশিদ শিপিং লিমিটেড। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে জাহাজ ডেলিভারি দিতে না পারায় হাইকোর্টে এই মামলাটি করা হয়েছে। জাহাজ বানানোর কথা বলে কয়েক দফায় প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা অগ্রিম নিয়ে ওয়েস্টার্ন মেরিন সেই টাকায় শোধ করেছে বকেয়া বিল ও কর্মীদের বকেয়া বেতন-বোনাস।

ওয়েস্টার্ন মেরিনের জাহাজ তৈরির কারখানাটি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কোলাগাঁওয়ে। এর প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রাম নগরীর স্ট্রান্ড রোড এলাকায়।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে দুবাইয়ের আল-রশিদ শিপিং লিমিটেডকে তিনটি জাহাজ বানিয়ে দেওয়ার চুক্তি করেছিল বাংলাদেশের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। দুই বছর পরও জাহাজ না পেয়ে সেই চুক্তিটি বাতিল করে দেয় দুবাইয়ের কোম্পানিটি।

বাংলাদেশের জাহাজনির্মাণ শিল্পে জড়িত ব্যক্তিবর্গ বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি জাহাজ নির্মাতাদের সুযোগ রয়েছে। ওয়েস্টার্ন মেরিন যে কাণ্ড করেছে, সেটা খুবই ন্যাক্কারজনক। এতে বাইরের দেশে বাংলাদেশের সুনাম ও ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।

গত বছরের জুনে হাইকোর্টে দায়ের করা এক পিটিশনে আল-রশিদ শিপিং কোম্পানি জানায়, ২০২০ সালের ১৮ মে চুক্তি বাতিল করার পর ৫ মিলিয়ন ডলার বা ৪৩ কোটি টাকার যে ক্ষতিপূরণ তারা চেয়েছে, তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিনকে দেওয়া পারিশ্রমিক, তাদের নিজস্ব ব্যয়, ব্যবসায়িক ক্ষতির পরিমাণ, লভ্যাংশ ও আইনি খরচ।

২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর চট্টগ্রামভিত্তিক জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ৫০ কোটি টাকার দুটি চুক্তি করে দুবাইয়ের আল-রশিদ শিপইয়ার্ড। এই চুক্তি অনুসারে জাহাজের যন্ত্রপাতি উৎপাদন, নির্মাণ, স্থাপন, আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ৬৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি এএইচটিএস জাহাজ ও দুটি ৬৫০০ টন ডেডওয়েটের ট্যাংকার চালু করা এবং নির্ধারিত সময়ে সেসব ডেলিভারি দিতে সম্মত হয় ওয়েস্টার্ন মেরিন।

দুই বছর আগে দুবাইভিত্তিক আল-রশিদ শিপিং লিমিটেডের প্রতিনিধির সঙ্গে চুক্তিপত্র বিনিময় করছেন ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন। সেই চুক্তিপত্র বাতিল হয়ে গেল ব্যয়বহুল এক মামলার মধ্য দিয়ে।
দুই বছর আগে দুবাইভিত্তিক আল-রশিদ শিপিং লিমিটেডের প্রতিনিধির সঙ্গে চুক্তিপত্র বিনিময় করছেন ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন। সেই চুক্তিপত্র বাতিল হয়ে গেল ব্যয়বহুল এক মামলার মধ্য দিয়ে।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, প্রথম পর্যায়ে ওয়েস্টার্ন মেরিনকে আট কোটি টাকারও বেশি পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। কথা ছিল, এই পারিশ্রমিক পাওয়ার ১৮ মাসের মধ্যেই দুবাইয়ের কোম্পানিকে তিনটি জাহাজ ডেলিভারি দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে ওয়েস্টার্ন মেরিন জাহাজ বানানোর কাজই শুরু করতে পারেনি।

একেবারেই পারেনি বললে ভুল হবে, চট্টগ্রামে ওয়েস্টার্ন মেরিনের শিপইয়ার্ডে দীর্ঘ এই সময়ে শুধু জাহাজের একটি প্লেট তৈরি করতে পেরেছিল কোম্পানিটি। অথচ দুবাইয়ের কোম্পানিটির কাছ থেকে তারা ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর প্রথম ধাপে এএইচটিএস জাহাজের জন্য ৫ লাখ ডলার এবং ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দুটি ট্যাংকারের জন্য ৩ লাখ চল্লিশ হাজার ডলার নিয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত আল-রশিদ কোম্পানি সবমিলিয়ে ১০ লাখ ১৩ হাজার ৫৮৭ ডলার দিয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিনকে।

দুবাইভিত্তিক জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল নতুন জাহাজে লাগানোর জন্য দুটি ইঞ্জিন ও যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে পাঠায়। কিন্তু ওয়েস্টার্ন মেরিন সেগুলো এখনও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাসই করেনি। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে থাকা যন্ত্রাংশের ওয়ারেন্টির মেয়াদও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়ে যায়। ওয়েস্টার্ন মেরিনের এই হেলাফেলার কারণেও আল-রশিদকে এসব পণ্যের জন্য বাড়তি খরচ শোধ করতে হয়।

ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহাইল হাসান অবশ্য বলছেন, ‘আল-রশিদ দুটি ইঞ্জিন পাঠিয়েছিল। কিন্তু আমরা এর জন্যে কোনো টাকা ধরিনি এবং কোনো এলসিও (লেটারস অব ক্রেডিট) খুলিনি। এইসব কারণে আমরা বন্দর থেকে পণ্যগুলো ছাড়াতে পারিনি। আল-রশিদ আমাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠিয়েছিল, কিন্তু এতে কিছুটা সময় লাগে। তার ওপর আমাদের দেশে পণ্য ছাড়ানোর প্রক্রিয়া এমনিতেই ধীরগতিতে চলে। কারণ এর সঙ্গে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বন্ড জড়িত।’

অভিযোগে জানা গেছে, দুই দফায় টাকা নেওয়ার পর ২০১৯ সালের ২১ মে ওয়েস্টার্ন মেরিন আবারও আল-রশিদের কাছে টাকা চায় ট্যাংকারের কাজ শুরু করবে বলে। ইঞ্জিন ও যন্ত্রপাতি বন্দর থেকে ছাড়িয়ে নেবার চার্জ দেখিয়ে তারা আবারও আল-রশিদের কাছে টাকা চায়। জবাবে আল-রশিদ শিপইয়ার্ড জানায়, শুধুমাত্র কাজের অগ্রগতি দেখলেই ওয়েস্টার্ন মেরিনকে তারা আর্থিক সহায়তা দেবে। কিন্তু তখন ওয়েস্টার্ন মেরিন কোনো অগ্রগতির প্রমাণ দিতে পারেনি।

দুই কোম্পানির মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী প্যানেল বা ব্লক নির্মাণের ২৫ ভাগ কাজ হবার পরেই ওয়েস্টার্ন মেরিন দ্বিতীয় ধাপের পারিশ্রমিক চাইতে পারবে— চুক্তিতে এমন শর্ত থাকলেও ওয়েস্টার্ন মেরিন বারবার আল-রশিদের কাছে টাকা চেয়ে নিয়েছে— এমন অভিযোগ করা হয়েছে হাইকোর্টের পিটিশনে। কিন্তু বাস্তব চিত্র হল, বারবার টাকা দেওয়ার পরও ওয়েস্টার্ন মেরিন জাহাজ তৈরির কাজই শুরু করেনি।

এ বিষয়ে আল-রশিদ শিপিং লিমিটেডের আইনজীবী শাহ মুহাম্মদ এজাজ রহমান বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ওয়েস্টার্ন মেরিনকে প্রচুর টাকা দিয়েছি। তবু তারা কাজ শুরু করেনি। এটি আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।’

জানা গেছে, দুবাইয়ের আল-রশিদ কোম্পানির কাছ থেকে পাওয়া টাকাটা ওয়েস্টার্ন মেরিন খরচ করেছে নিজেদের কর্মীদের বেতন, বোনাস ও অন্যান্য বিল বাবদ।

এ কথা স্বীকার করে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহাইল হাসানও বললেন, ‘আমাদের ৪০০-৫০০ কর্মীর বেতন-বোনাস, শিপইয়ার্ডের ইলেকট্রিক বিল ইত্যাদি দিতে ওই টাকা আমরা অ্যাডভান্স নিয়েছি। যা পরবর্তী পেমেন্টের সঙ্গে সামঞ্জস্য করা হবে। আর আমরা যতখানি পারিশ্রমিক পেয়েছি, সে অনুযায়ীই কাজ করেছি। আমরা রড, বিদেশি স্টিল ইত্যাদি কিনেছি এবং ডিজাইন অনুমোদন করিয়েছি।’

২০২০ সালের ১৮ মে আল-রশিদ শিপিং কোম্পানি তাদের চুক্তি বাতিল করার পর ওয়েস্টার্ন মেরিনের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে। গত জানুয়ারি মাসে সেই মামলার শুনানিতে হাইকোর্ট রোববার (৭ ফেব্রুয়ারি) পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেন। এর মধ্যে নিজেদের মধ্যে আপসে সমস্যা সমাধানেরও সুযোগ দেন আদালত। তবে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড সেরকম কোনো প্রস্তাব এখনও দেয়নি দুবাইয়ের কোম্পানিটিকে।

আল-রশিদ শিপিং লিমিটেডের আইনজীবী শাহ মুহাম্মদ এজাজ রহমান বলেন, ‘ এটা আমাদের কঠিন সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। হাইকোর্ট আপসে সমস্যা সমাধানের সুযোগ দিলেও আমরা ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের কাছ থেকে কোনো রকম প্রস্তাব পাইনি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!