দুদক নড়তেই লাপাত্তা চট্টগ্রামের হায় হায় কোম্পানির কর্তারা, গোপনে চলছে ভবন বেচাকেনা

রূপসা কিংয়ের তিন লাখ গ্রাহকের চোখে অন্ধকার

চট্টগ্রামের ইপিজেডের কথিত মাল্টিপারপাস কোম্পানি রূপসা কিং গ্রুপের মার্কেটিং সিন্ডিকেটের ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছে প্রায় তিন লাখ গ্রাহক। এসব গ্রাহকের বেশিরভাগই হচ্ছেন চট্টগ্রাম ইপিজেডের পোশাক শ্রমিক। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ওই ‘হায় হায়’ কোম্পানির চেয়ারম্যানসহ পরিচালকদের সম্পদের তদন্ত শুরু করলে নড়েচড়ে বসে প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা।

এদিকে দুদকের তদন্তের খবর প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে আমানতের টাকার জন্য প্রতিদিন সমিতির দপ্তরে ভিড় করছেন বেশিরভাগ গ্রাহক। সমিতির অফিস নিয়মিত খোলা থাকলেও দুদকের অনুসন্ধান শুরু হওয়ার পর থেকে অফিসে বসছেন না চেয়ারম্যানসহ পরিচালকরা। তাদের মার্কেটিং সিন্ডিকেটের লোকজনরা গ্রাহকদের শান্ত রাখার চেষ্টা করলেও আমানতের টাকা ফেরত পাওয়া অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন প্রায় সব গ্রাহকই।

অভিযোগ রয়েছে, দুদকের অনুসন্ধান শুরুর পর গ্রাহকের আমানতের টাকায় কেনা রূপসা কিং গ্রুপের অন্তত ২৫টি বহুতল ভবন ও দোকানপাট গোপনে বেচাকেনার কাজ চলছে। ‘রূপসা ভবন’ নামে যে ভবন ও সেখানে দোকানপাট রয়েছে সেসব সম্পদ কেনা হয়েছে গ্রাহকের আমানতের টাকায়। কিন্তু সেগুলোর মালিকানা রয়েছে সমিতির পরিচালকদের নামে-বেনামে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রূপসা কিং গ্রুপের চেয়ারম্যান ও পরিচালকের নামে-বেনামে রয়েছে বহুতল ভবন, দোকান ও মার্কেট। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, ইপিজেড ও বন্দর থানা এলাকায় পরিচালকদের নামে রয়েছে এসব ভবন ও মার্কেট। এর মধ্যে ইপিজেড থানার বন্দরটিলা নয়ারহাট ডকইয়ার্ড রেশন গেইট এলাকায় রয়েছে চার তলা ভবন, বন্দরটিলা কসাইগলিতে রয়েছে পাঁচ তলা ভবন, নেভী হাসপাতাল রেলবিটের এলাকায় পাঁচ তলা একটি ভবন, সিমেন্ট ক্রসিং কাজির গলির বিপরীতে তিন তলা একটি ভবন রয়েছে এই সমিতির।

এছাড়া ইপিজেড থানার কলসিদিঘী পাড়ার বালুর মাঠের সামনে একটি নিচতলা মার্কেটসহ দুই তলা একটি ভবন রয়েছে। বন্দর থানার ওমর শাহ মাজার সংলগ্ন ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় ছয় তলা একটি ভবন, বন্দর থানার গাজী ওমর শাহ রোডে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসহ তিন তলা নির্মাণাধীন ভবন, বন্দর থানার ধুমপাড়া বশির মাহমুদ রোডে পাঁচ তলা ভবন, বন্দর থানার ধুমপাড়া বশির মাহমুদ রোডে একই জায়গায় রয়েছে আরও একটি ছয় তলা ভবন। পাশাপাশি ইপিজেড থানার বোবা কলোনিতে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এবং একই গলির ভেতরে রয়েছে প্রায় আট শতাংশ জমি— যার বাজারমূল্য প্রায় চার কোটি টাকা। ইপিজেড থানার চৌধুরী মার্কেটের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলার পুরো ফ্লোরটি সম্পূর্ণ রূপসার কিং গ্রুপের নামে রয়েছে।

চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি ওবাইদুল্লাহ রুবেল নামের এক প্রয়াত পরিচালকের পরিবারের পক্ষে একটি অভিযোগের ভিত্তিতে ‘রূপসা কিং গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ। ওইদিন ১৪ ঘন্টার অভিযানে সেখান থেকে নগদ ৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা জব্দ করা হয়। ঘটনার পর প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যান মুছা হাওলাদার, পরিচালক গোলাম ফয়সাল এবং প্রকল্প পরিচালক রাসেল হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করা হয়।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে রূপসা কিং গ্রুপের চেয়ারম্যান ও পরিচালকের বিরুদ্ধে সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর গত ১ অক্টোবর দুপুরে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এ রূপসা কিং গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ মোট পাঁচজনকে তলব করা হয়। এরা হলেন রূপসা কিং গ্রুপের চেয়ারম্যান লায়ন মুজিবুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান মুছা হাওলাদার, প্রকল্প পরিচালক রাসেল হাওলাদার, পরিচালক জাকির হোসেন ও পরিচালক আবুল কালাম।

প্রায় ১৪ বছর আগে চট্টগ্রামের ইপিজেড থানার চৌধুরী মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় রূপসা মাল্টিপারপাস নামে যাত্রা শুরু করে। অল্প সময়ে দ্বিগুণ টাকার লোভ দেখিয়ে বছর না পেরোতেই তাদের গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়ায় কয়েক লাখ। গ্রাহক বাড়ার পরিবর্তন হয় সমিতির নামও। বর্তমানে রূপসা কিং গ্রুপ সমিতির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় তিন লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা।

জানতে চাইলে রূপসা কিং গ্রুপের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘রূপসা নামে ভবন ও দোকানসহ কোনো স্থাপনা গোপনে বেচাকেনা হচ্ছে না। কেউ হয়ত আপনাকে মিথ্যা বলতে পারে। আমাদের কেনা ভবনগুলোতে একটা কালার ও রূপসা ভবন নামে লেখা যুক্ত রয়েছে।’

দুদকের অনুসন্ধান শুরু হওয়ার পর থেকে চেয়ারম্যানসহ পরিচালকরা কেন অফিসে বসছেন না— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি একটু অসুস্থ। তাই অফিস করতে পারছি না। আমাদের কর্মকর্তারা অফিস করছেন। গ্রাহকের সঙ্গে টাকা দেওয়ার কথা চলছে।’

এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান কর্মকর্তা বলেন, ‘রূপসার নামে কেনা সম্পত্তিগুলো বেচাকেনা করার বিষয়ে আমি জানি না। সম্প্রতি তাদের তলব করার পর তাদের কাছ থেকে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তদন্ত চলছে। ভবন বা মার্কেট বেচাকেনার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি।’

এমএফও/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!