চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দুই গ্রুপের কোন্দল ও বারবার হানাহানির মূল কেন্দ্র হল প্রধান পুরুষ ছাত্রাবাস ও ইন্টার্ন হোস্টেল মিজান ছাত্রাবাস। এ দুই হোস্টেলকে কেন্দ্র করেই ছাত্রদের হাতে মুহূর্তেই ওঠে আসে হকিস্টিক, চলে সংঘর্ষ। রক্তপাতের ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল পুরোটাই এখন ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু সেই ছাত্রলীগই এখন দুটো ভাগে বিভক্ত। এর একাংশ সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের অনুসারী এবং অন্য অংশ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী। ছাত্রশিবিরকে ক্যাম্পাস থেকে হটিয়ে দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণে একাধিপত্য ছিল নাছির অনুসারী ছাত্রলীগের। কিন্তু গত বছর থেকে ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণে ভাগ বসায় নওফেল অনুসারীরা।
চট্টগ্রামের চকবাজার থানার চট্টেশ্বরী রোডে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের প্রধান ছাত্রাবাসটি অবস্থিত। এই ছাত্রাবাসের দুটি ব্লক রয়েছে। দুটি ব্লকের একটি নওফেল অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে এবং অন্যটিতে রয়েছে আ জ ম নাছির অনুসারীদের আধিপত্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নওফেল অনুসারীরা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে অধিক সক্রিয় থাকলেও পুরো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র রাজনীতি, ছাত্রলীগের কমিটি ও সংসদ রয়েছে নাছির অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে। দীর্ঘ প্রায় ২৬ বছর ধরে নাছির অনুসারীরা ছাত্রলীগের মেডিকেল কলেজ ইউনিটটি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
চলতি বছরের ২ মার্চ চমেকের প্রধান ছাত্রাবাসে সিট দখল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, ছাত্রাবাস থেকে নওফেল অনুসারীরা জোরপূর্বক নাছির অনুসারীদের বের করে দেওয়ার চেষ্টা করলে তারা বাধা দেয়। এরপর একে অপরের ওপর হকিস্টিক ও লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণ করে। এ সময় ছাত্রাবাসের অন্তত ১২টি কক্ষে ভাংচুর চালানো হয়। কক্ষ থেকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়ে বই-খাতাসহ বিভিন্ন শিক্ষাসামগ্রী। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ৫ জন আহত হন। সংঘর্ষে জড়ানো দুই গ্রুপই ঘটনার জন্য পরস্পরকে দায়ী করে।
নওফেল অনুসারীদের অভিযোগ, হোস্টেলের সিট নিয়েই মূলত ওইদিনের ঘটনার সূত্রপাত। ইন্টার্ন চিকিৎসক যারা আছেন তাদের আলাদা থাকার ব্যবস্থা থাকলেও তারা হল ছাড়ছেন না। নানারকম বাহানা দিয়ে তারা হলে থাকছেন। ফলে অনেক শিক্ষার্থীকেই গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে তাদের অভিযোগ।
এরপর গত মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) সিএমসি ক্যান্টিনে এক ছাত্রলীগ নেতাকে কটুক্তির ঘটনায় দুই পক্ষের মধ্যে আবার সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত পাঁচজন আহত হন। এর জের ধরে পরদিন ২৮ এপ্রিল থেকে আ জ ম নাছিররের অনুসারী ইন্টার্ন চিকিৎসকরা হাসপাতালে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট পালন করেন। রোববার (২ মে) হাসপাতাল প্রশাসনের আশ্বাসে তারা কর্মবিরতি স্থগিত করেন। ইন্টার্ন চিকিৎসকদের প্রশাসনকে আশ্বস্ত করে, তিনদিনের মধ্যে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ আশ্বাস পেয়ে তারা কর্মবিরতি তিনদিনের জন্য স্থগিত করে। সেই তিনদিন শেষ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার (৪ মে)।
সাম্প্রতিক সময়ে হলে আধিপত্য বিস্তার ও হল দখলের ঘটনায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট। কলেজ প্রশাসন সূত্রে তখন জানা যায়, করোনাকালে কলেজ বন্ধ থাকলেও ছাত্রাবাস অফিসিয়ালি বন্ধ করা হয়নি। সেখানে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা থাকতেন।। ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। বন্ধের মধ্যেও তারা ছাত্রাবাসে অবস্থান করছে জানতে পেরে উপমন্ত্রী নওফেলের অনুসারী অন্য ছাত্ররা সেখানে যান। তারা ছাত্রাবাসে উঠতে চাইলে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা তাদের বাধা দেন। পরে এ নিয়ে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ওই ঘটনায়ও আহত হন ৫ জন।
জানা গেছে, চমেক ইন্টার্ন হোস্টেলের সিট ১০৬টি। কিন্তু ইন্টার্ন চিকিৎসকের তুলনায় সিট কম থাকায় ২০ থেকে ২৫ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক প্রধান ছাত্রাবাসে গিয়ে থাকেন। এ নিয়ে রয়েছে নওফেল অনুসারীদের ক্ষোভ।
বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে চমেক ইন্টার্ন এসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ওসমান গণি বলেন, ‘তখন আমাদের ইন্টার্ন হোষ্টেলে আগের ব্যাচের বড় ভাইয়েরা ছিল। তাই বাধ্য হয়ে আমরা প্রধান ছাত্রাবাসে ছিলাম। কিন্তু এখন তো নওফেল অনুসারী বহিরাগতরা এসে ইন্টার্ন হোস্টেল দখল করে নিতে চাইছে। তারা তো মেডিকেল স্টুডেন্ট না। তারা কেন ইন্টার্ন হোস্টেলে এসে থাকতে চাইবে?’
এদিকে সংঘর্ষের সবশেষ (২৭ এপ্রিল) ঘটনায় পাল্টাপাল্টি মামলা দায়ের করেছে উভয় পক্ষ। বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) বিকেলে চমেক ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান বাদি হয়ে ১৩ জনের নাম উল্লেখ ও ৭০-৮০ জনকে অজ্ঞাত করে একটি মামলা দায়ের করেন। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের অনুসারী বলে পরিচিত। এ মামলায় আসামিরা হলেন অভিজিৎ দাশ, মুশফিকুর ইসলাম আরাফ, মো. রিয়াজুল ইসলাম, তৌফিকুর রহমান, সৌমিক বড়ুয়া, আতাউল্লাহ বুখারী, এইচ এম ফজলে রাব্বি সুজন, সুভাষ মল্লিক সবুজ, সাদ্দাম হোসেন ইভান, রবিউল ইসলাম রাজু, ইয়াসিন আওরাজ ভূঁইয়া রওনক প্রকাশ ভূঁইয়া রনক, মোহাম্মদ হানিফ ও জিয়াউদ্দিন আরমান। আসামিরা সবাই শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
ওইদিন (২৯ এপ্রিল) দিবাগত রাতে আরেকটি পাল্টা মামলা দায়ের করেন শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেলের অনুসারীরা। রিয়াজুল ইসলাম জয় বাদি হয়ে ১৭ জনের নাম উল্লেখ ও ১৫-২০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন। মামলায় আসামিরা হলেন ডা. হাবিবুর রহমান, আল আমিন শিমুল, ডা. ওসমান গণি, ডা. অতন্দ্র আকাশ, ডা. এ এল এন এস শাহরিয়ার, ডা. মাসুম বিল্লাহ মাহিন, সাইফুল আলম লিমন, ফরিদ আহমেদ, সুজয়মান বড়ুয়া জিতু, ওয়াহেদুল আলম শিমুল, আলাউদ্দিন আলো, শাহরিয়ার মো. রাহাতুল ইসলাম, মিনহাজ আরমান লিখন, মাহাদী বিন হাসিম, ডা. তাজওয়ার রহমান অয়ন, পল্লব বিশ্বাস ও মো. ইফরাইন। এই আসামিরা সবাই আ জ ম নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
ইন্টার্ন ডাক্তারদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। রোববার (২ মে) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া দুই আসামি হলেন রবিউল হোসেন রাজু ও মো. হানিফ। তারা দুজনই চমেক হাসপাতালে সংঘর্ষের ঘটনায় চমেক ছাত্রলীগের সভাপতি ডা. হাবীবুর রহমানের দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।
এদিকে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বেঁধে দেওয়া তিনদিনের সময়সীমা শেষ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার (৪ মে)। তিনদিন শেষে কী সিদ্ধান্ত নেবে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা— এমন প্রশ্নের জবাবে চমেক ইন্টার্ন এসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ওসমান গনি বলেন, ‘আমরা পরিচালক স্যারের সাথে বসব। আমাদের মূল দাবি মামলার আসামি যেসব বহিরাগতের নাম আছে তাদের গ্রেফতার করা। কারণ তারা আইনের আওতায় না আসলে দিনের পর দিন এসব ঘটনা চলতেই থাকবে। যা মেনে নেওয়া যায় না।’
কিন্তু বহিরাগত বলে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও মামলা দায়ের তাদেরই একজন ফজলে রাব্বী সুজন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিদ্যা অনুষদের অন্তর্ভূক্ত একটি কলেজ। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলাম। এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন এমফিল গবেষক শিক্ষার্থী। তাহলে আমি মেডিকেল কলেজে বহিরাগত হলাম কিভাবে?’
সুজন আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন চমেক ও হাসপাতালে আ জ ম নাছির অনুসারীদের আধিপত্য চলে আসছে। তাদের পাঁঠার বলি কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। পাস করে চলে যাওয়ার পরও বাপ-দাদার সম্পত্তির মত প্রধান পুরুষ ছাত্রাবাস ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের মিজান হোস্টেলকে ব্যবহার করছে। সেখানে থেকে অন্য জায়গায় চাকরি করছে। আজ ওদের জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলে থাকতে পারছে না। ইন্টার্ন চিকিৎসকরা আজ হাসপাতালের ওষুধ চুরিসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত। রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না। আমি একজন ছাত্রনেতা হিসেবে এর প্রতিবাদ করতে এসেছি। আমাকে আইনের আওতায় নিতে পারবে, যদি আমি দোষী হই। কিন্তু কেউ একজন অভিযোগ করলেই তো আমি দোষী হয়ে গেলাম না। হোস্টেলের সিট নিয়ে অনিয়ম ও দৌরাত্ম্য প্রতিহত করতে আমরা সচেষ্ট থাকবই।’
সিপি