দুই মাস ধরে খাবার পানি নেই চট্টগ্রাম মেডিকেলে, মেশিন নষ্ট

হাত জ্বালাপোড়ার অনুভূতি নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার জানান লিভার জন্ডিস এবং কিডনি সমস্যা। ডাক্তারের কথায় স্বস্তি না পেয়ে জন্ডিসের উপসর্গ নিয়ে রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হন আব্দুর রউফ। সাথে কেবল স্ত্রী লুৎফুন নাহার। ভর্তির পরপরই ডাক্তার অনেকগুলো পরীক্ষার নাম আর ওষুধের নাম লিখে দেন। চট্টগ্রামে তেমন কোনো পরিচিত কিংবা আত্মীয় স্বজন নেই। হাতে কেবল স্বল্প কিছু টাকা নিয়েই ছুটে আসেন চমেক হাসপাতালে স্বামীর চিকিৎসা করাতে। এতো মানুষের হিজিবিজিতে লুৎফুন নাহার নিজেই যেন কাহিল। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ কেনার পর ওয়ার্ডে এলে অসুস্থ স্বামী জানান পানি খাবে। টাকা গুনে দেখেন হাতে আছে আর মাত্র ২০ টাকা। ৫০০ মিলিলিটার পানি কিনতেই গেল ২০ টাকা। লুৎফুন নাহারের হাত একেবারে শূন্য। এই আধা লিটার পানি শেষ হতেই অস্থির হয়ে পড়েন পানির জন্য।

গার্ড, আয়া, নার্স, অন্যান্য মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে করে ছুটলেন খাবার পানির জন্য। ছুটতে ছুটতে মানসিক ওয়ার্ডের পাশে যেতেই চোখে পড়ে সবুজ কালিতে বড় বড় অক্ষরে সাইনবোর্ডে লেখা আছে বিশুদ্ধ খাবার পানি। লুৎফুন নাহার যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে ভাবলেন, পানি তাহলে আর কিনে খেতে হবে না। কাছে গিয়ে নল ঘোরাতেই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। দৃশ্যমান দুটো পানির (ট্যাপ) নল থাকলেও তাতে পানির দেখা নেই। সাইনবোর্ডের লেখায় পানির দেখা পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচার দীর্ঘশ্বাস ক্রমান্বয়ে ভারী হতে থাকে লুৎফুন নাহারের।

এভাবে প্রায় প্রতিদিনই খাবার পানির খোঁজে ছুটোছুটি করে নিরাশ হয়ে ফিরতে হয় চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনদের। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা পানি কিনেন। কেউ কেউ বাসা থেকে আনেন। আর দূরদুরান্ত থেকে আসা রোগীদের শেষ ভরসা হয় দোকান, না হয় হাসপাতালের পানি। কিন্তু প্রায় দেড় মাস ধরে অচল চমেক হাসপাতালের একমাত্র ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (বিশুদ্ধ খাবার পানি শোধনাগার)। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, কারিগরি ত্রুটির কারণে ১৫-২০ দিন ধরে পানি সরবরাহ বন্ধ এই প্লান্টে। সচল করতে কাজ চলমান। তবে এতোদিনেও দেখা নেই বিশুদ্ধ পানির।

২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে সাপ্তাহিক গণশুনানিতে রোগীর স্বজনদের অসংখ্য অভিযোগের মাঝে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটের অভিযোগও আসে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের সহযোগিতায় চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি উদ্বোধন করা হয়েছে এই বিশুদ্ধ খাবার পানির শোধনাগার। বছর না পেরুতেই এটিও অচল হয়ে পড়ে আছে। হাসপাতালে ওয়াসা এবং ডিপ টিউবওয়েল ছাড়া পানির দ্বিতীয় আর কোনো উৎস নেই। এদিকে, ওয়াসার পানি হাসপাতালে খাবারপানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। ডিপ টিউবওয়েলের পানি হাসপাতালের ক্যানটিনে থাকলেও রোগীরা সে পানি খেতে পায় না। খেতে হলে তাও কিনে খেতে হয়। আর হাসপাতালের এই ডিপ টিউবওয়েলের এক লিটার পানির দাম ২০ টাকা। যা সরাসরি দোকান থেকে কিনতে হলে পায় আধা লিটার পানি।

৫০০ শয্যার কাঠামোতে নির্মিত ১ হাজার ৩১৩ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ভর্তি থাকছে তিন হাজার রোগী— যা ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি। প্রতিদিন নতুন রোগী ভর্তি হয় ৬০০ থেকে ৭০০ জন। এই বিপুলসংখ্যক রোগীর বেশিরভাগই দরিদ্র। যাদের প্রতিদিন বিশুদ্ধ খাবার পানি কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। এতো বিশাল বড় হাসপাতালে কেবল একটাই বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা হয়েছিল রোগীদের জন্য তাও দীর্ঘদিন ধরে অচল।

১২ নম্বর ওয়ার্ডের চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন হোসনে আরা বেগম বলেন, ‘ইয়ানে আমগো কোনো আত্মীয় নাই। এডা নাকি গরিবের হাসপাতাল। খালি সিট ভাড়া দেওন লাগে না আর বেজ্ঞিন কিনন লাগে। ডাক্তররা কতাগ্গিন টেস্ট আর ওষুধ দেয়। ইয়ানে পানিও কিনি খান লাগে। কিয়া কইতাম আর। কই যামু কন।’

আরেক রোগীর স্বজন বলেন, ‘আমরা অনেক দূর থেকে আসছি। পানি আনার ব্যবস্থা নাই। এখানে দুইবার মাত্র পানি দেয় বাথরুমে যাওয়ার জন্য। এই পানি ধরে রাখা লাগে। খাওয়ার কোনো পানি নাই। ক্যানটিনে গেলে সেখানেও পানি কিনতে হয়। এতো বড় হাসপাতালে খাওয়ার কোনো ভালো পানি নাই। বাইরের মানুষ শুনলে হাসবে।’

এ প্রসঙ্গে চমেক হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার রাজীব কুমার দে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওটার মোটর সম্ভবত নষ্ট হয়ে গেছে। ওইভাবে আর বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা নেই। যেটা আছে সেটা ওয়াসা এবং ডিপ টিউবওয়েল থেকে আসে। আর খাবার পানি ক্যানটিন থেকে সংগ্রহ করতে পারে না হয় কিনে আনে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মকর্তা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মেডিকেলে যে পানি সাপ্লাই দিচ্ছে ওসব পানি তো প্যাশেন্টরা (রোগীরা) খায় না। এখানে রোগীরা যে যার মতো পানি নিয়ে আসে অথবা কিনে আনে। আর হাসপাতাল থেকে খাওয়ার পানির আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। মেইনলি বাথরুমে ব্যবহার করার জন্য সরবরাহ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেএসআরএমের মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘রোগীদের সুবিধার্থে আমরা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটি মেডিকেলে স্থাপন করেছিলাম। কিন্তু এটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মেডিকেল কর্তৃপক্ষের, আমাদের নয়। তবু বিষয়টা যেহেতু আমরা জেনেছি, আমাদের যদি কিছু করণীয় থাকে, আমরা করার চেষ্টা করবো।’

এ প্রসঙ্গে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহসেন উদ্দিন আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পানি নেই তা নয়। সেখানে একটা জিনিস নষ্ট হয়ে আছে। ওটা চেঞ্জ করে দেয়া হয়েছে। এটা প্রায় ১৫-২০ দিন আগে নষ্ট হয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না এখন খাবার পানি পাচ্ছে না। বাট সাপ্লাইয়ের পানি আছে। সেগুলো তারা ইউজ করছে। সামনে পানির পয়েন্ট আছে সেখান থেকে ইউজ করছে। আমরা পাইপ ঘুরাই দিছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ওটার কাজ চলতাছে, চালু হবে। এখানে যে ইলেকট্রনিক পাওয়ার পয়েন্টের লাইন আছে ওই লাইনে ডিস্টার্ব করতেছে। যাতে পরে আর প্রবলেম না হয় সেটার জন্য খেয়াল রাখা হচ্ছে। একটা সার্কিটের পয়েন্ট আছে। ওটা ঠিক করা হচ্ছে। তারপর ঠিক হবে।’

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!