দুই ঘাটের ইজারা নিয়ে কর্ণফুলীর ৬ ঘাট দখল, চার কোটির ধান্ধা বছরে

চট্টগ্রাম নগরের ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার মেরিনার্স সড়কের পাশে কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে দুটি ঘাট ইজারা নিয়ে আরও চারটি বেনামি ঘাট অবৈধভাবে দখলে নিয়ে মাশুল আদায় করছেন জাহাঙ্গীর আলম এক ইজারাদার। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর চর এলাকায় বিভিন্ন ভাসমান ব্যবসা, দোকানপাট ও বিভিন্ন স্থাপনা থেকে প্রতিদিন আদায় করা হচ্ছে কয়েক লাখ টাকা। অনুসন্ধানে জানা যায়, বছরে সবমিলিয়ে প্রায় চার কোটি টাকার বাণিজ্য করছেন ইজারাদার জাহাঙ্গীর আলম ও তার সিন্ডিকেট।

চসিক সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত দুটি ঘাটের ইজারা নেন জাহাঙ্গীর আলম। এর মধ্যে নতুনঘাট ৬ লাখ ৯৬ হাজার ২৪৫ টাকায় এবং ফিশারীঘাট ১৮ লাখ ২০ হাজার ৩০৮ টাকা ইজারা নেন তিনি। একই মেয়াদে চাক্তাই খালের পান ঘাট থেকে গাইজ্জের ঘাটের ইজারা নেন নুর আহমদ নামের আরেক ব্যক্তি। এটির ইজারা হয়েছে ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকায়। অন্যদিকে মাত্র ২০ হাজার টাকায় চাক্তাই পাঁচ লবণ ঘাটের ইজারা নেন তানজিল হক চৌধুরী।

অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে রিকশা গ্যারেজ ও নিষিদ্ধ শুকরের খামার।
অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে রিকশা গ্যারেজ ও নিষিদ্ধ শুকরের খামার।

জানা যায়, সিটি কর্পোরেশন থেকে জাহাঙ্গীর আলম নতুনঘাট ও ফিশারীঘাট ইজারা নিলেও প্রভাব খাটিয়ে দখলে নিয়েছেন বন্দরের তালিকাভুক্ত চাক্তাই ঘাট এবং তিনটি বেনামি ঘাট—লইট্যা ঘাট, ১ নম্বর ফিশারী ঘাট ও নতুনবাজার ঘাট।

অভিযোগ আছে, কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকায় যে কোন ধরনের স্থাপনা নির্মাণের ওপর হাইকোর্টে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও ৪-৫ বছর ধরে ইজারাদার জাহাঙ্গীর আলম ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে একচেটিয়া দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে। এসব স্থাপনা ও ঘাটগুলোর দখল থেকে বছরে কয়েক কোটি টাকা মাশুল আদায় করা হচ্ছে বর্তমানে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বেনামি ও অবৈধ ঘাটগুলো থেকে মাশুল আদায় করছে চসিকের ইজারাদার জাহাঙ্গীর আলম ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা। চরে অবস্থান করা মাছ ধরার ফিশিং বোট, নদীতে নোঙ্গর করা বোট ও তেলবাহী বোটগুলো থেকে মাশুল নিতে দেখা গেছে সিন্ডিকেট সদস্যদের। ঘাটে নোঙ্গর করা বোট থেকে নেওয়া হচ্ছে ৫০০ টাকা। সাগর থেকে মাছ শিকার করে তীরে আসার পর নেওয়া হয় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। বোট থেকে মাছ নামানোর সময় প্রতি মাছের খাঁচা বাবদ নেওয়া হয় ৩০ টাকা। মাছের ঠেলাগাড়ি থেকে নেওয়া হয় ৩০০ টাকা। এছাড়া ১২০টি ভাসমান দোকানপাট থেকে মাসিক এককালীন নেওয়া হচ্ছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। জানা গেছে, ওই এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে রিকশা গ্যারেজ ও নিষিদ্ধ শুকরের খামার। শুধু তাই নয়, ইলিশ মাছের মৌসুমকে ঘিরে চলছে জুয়ার আসর, সন্ধ্যার পর চলে অসামাজিক কর্মকাণ্ড।

বোট এসেছে, টাকা আদায়ের জন্য তৈরি সিণ্ডিকেটের সদস্যরাও।
বোট এসেছে, টাকা আদায়ের জন্য তৈরি সিণ্ডিকেটের সদস্যরাও।

জাহাঙ্গীর আলম সিটি কর্পোরেশনের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুল হকের পুত্র। তার সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা হলেন পুলক খাস্তগীর, তাপস দাশ ও শুক্কুর। স্থানীয়রা জানান, ইজারাদার জাহাঙ্গীর আলম ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার নাম ভাঙ্গিয়ে দুই ঘাট ইজারা নিয়ে কর্ণফুলী নদীর চর, চাক্তাই ও ফিশারিঘাট এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। শুধু চলতি ইলিশ মাছের মৌসুমে মাছের ফিশিং বোট ও নদীর চর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তারা কোটি টাকার বাণিজ্য করছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান।

এদিকে বন্দর সূত্র বলছে, ২০১৫ সাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের আওতাধীন ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রকল্পের কাজ শুরু হলে প্রকল্পটির কাজ পুরোদমে শুরু হয় ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে। প্রাথমিকভাবে সদরঘাট থেকে বাকলিয়া নদীর চর পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করা পরিকল্পনা করা হয়। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪২ কোটি টাকা। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের প্রকল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার মেরিনার্স সড়কে চট্টগ্রাম বন্দরের তালিকায় থাকা চাক্তাই ঘাটসহ মোট সাত ঘাট ইজারার অনুমোদন না দিতে বলা হয় সিটি করপোরেশনকে। ওই ঘাটগুলো ইজারা না দিতে সিটি করপোরেশনকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েও অনুরোধ করা হয় চার বছর আগে। ২০১৫ সালের শেষ দিকে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফিশারিঘাটে অভিযান চালিয়ে কয়েকটি অবৈধ ঘাট ভেঙ্গে দেওয়া হয়।

কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকায় স্থাপনা নির্মাণের ওপর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা আছে। তবু কে শোনে কার কথা!
কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকায় স্থাপনা নির্মাণের ওপর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা আছে। তবু কে শোনে কার কথা!

চট্টগ্রাম বন্দরের তালিকাভূক্ত সাতটি ঘাট হচ্ছে চাক্তাই ঘাট, অভয়মিত্র ঘাট, সদরঘাট, বাংলাবাজার ঘাট, ডাঙ্গারচর ঘাট, ১২ নম্বর ঘাট ও ১৫ নম্বর ঘাট। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষের চিঠি ও অনুরোধ উপেক্ষা করে ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ফিশারীঘাট, নতুন ঘাট (ফিশারিঘাট), চাক্তাই খাল থেকে গাইজ্জের ঘাট, চাক্তাইয়ে লবণের পাঁচটি ঘাট ইজারা দেয়। করপোরেশনভুক্ত ‘চাক্তাই ঘাট’ গত তিন বছর ধরে ইজারা হয়নি। এর মধ্যে ‌‘চাক্তাই ঘাট’ ছাড়া বাকি চারটি ঘাটের কোন অস্তিত্বও নেই বন্দরের তালিকায়।

জানতে চাইলে কয়েকজন ফিশিং বোটচালক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, গত দুই মাস ধরে সাগরে মাছ শিকার করছি। ফিশারিঘাট বোট নোঙ্গর করলে দেয় প্রতি ফিশিং বোট বাবদ ৫০০ টাকা দিতে হয়। জাহাঙ্গীরের লোকজন এসেই টাকা নিয়ে যায়। মাছ ধরে আনার পর আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা ছাড়াও বড় বড় ৫-৬টি মাছ দিতে হয় তাদের।

অভিযোগ প্রসঙ্গে ঘাট ইজারাদার মো. জাহাঙ্গীর আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে গত বছর দুটি ঘাটের ইজারা নিয়েছি। ফিশারিঘাটসহ বাকিঘাটগুলো থেকে ইজারা নেওয়ার অনুমতি আছে। তাই প্রতিদিন এসব ঘাটগুলো থেকে মাশুল করা হয়।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ভূমি কর্মকর্তা এখলাস উদ্দিন আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ফিশারিঘাট ও চাক্তাইঘাট এলাকায় সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভূক্ত পাঁচটি ঘাট রয়েছে। বর্তমানে চারটি ঘাট ইজারা দেওয়া হয়েছে। চাক্তাইঘাট গত তিন বছর ধরে দরপত্র আহ্বান করে সাড়া পাওয়া যায়নি। এটাও সিণ্ডিকেটের কারসাজি বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। বন্দরের অনুমতি ছাড়া ঘাটগুলো অনুমতি প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

চট্টগ্রাম বন্দরের ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) জিল্লুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ২০১৫ সাল থেকে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের তালিকায় থাকা সাতটি ঘাটের কাউকে ইজারা না দিতে সিটি করপোরেশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করা হয়েছে। এর আগে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই এলাকার ঘাটগুলো ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। প্রয়োজন হলে আবারও অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানান।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!