চট্টগ্রামে দুই এমপির আবাহনী ক্লাবে প্রতিরাতের হাতবদল কোটি টাকা!

চট্টগ্রামের নামি স্পোর্টিং ক্লাব হিসেবে পরিচিত ‘চট্টগ্রাম আবাহনী লিমিটেড’। শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টের প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবসহ দেশের সব শ্রেণীর লীগে অংশ নিয়ে থাকে চট্টগ্রামের শীর্ষ এ ক্লাবটি। নগরীর হালিশহর থানার হালিশহর হাউজিং এস্টেটের জি ব্লকের প্লট এ/২-এ ১১ দশমিক ৭০ বিঘা জমির ওপর ক্লাবটির রয়েছে নিজস্ব স্থাপনা। তবে সেই জমিতে একটি খেলার মাঠ থাকলেও তা দীর্ঘদিন ধরে খেলার অনুপযোগী। টিনশেডের সেমিপাকা সাত কক্ষের একটি ‘এল’ আকৃতির ঘর থাকলেও সেখানে খেলোয়াড়ের জন্য কোনও ব্যবস্থা নেই। নেই কোনও ক্রীড়া সামগ্রীও। শুধুমাত্র সীমানা প্রাচীরের ভেতর গেটের পাশে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বঙ্গবন্ধুর বড় সন্তান শেখ কামালের একটি প্রতিকৃতি রয়েছে।

কাগজে কলমে এই ক্লাব থেকেই চট্টগ্রাম আবাহনীর সব কার্যক্রম পরিচালিত হলেও সেখানে নিয়মিত যাতায়াতও করেন না ক্লাবের একাধিক উর্ধতন কর্মকর্তা। তবে আবাহনী ক্লাবের সেই স্থাপনা ঘিরে সবসময়ই রয়েছে রমরমা জুয়ার আসর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার গত বুধবার শেষ বসেছিল এই জুয়ার আসর। এর আগের চিত্র ছিল অন্যরকম। ফুটবল খেলার প্রতিনিধিত্ব করা এই ক্লাবটিতে সন্ধ্যা হলেই বেড়ে যেত জুয়াড়িদের আনাগোনা। রাত যত গভীর হতো ততই জমে উঠতো এই জুয়ার আসর। হাজার থেকে লাখ, লাখ থেকে কোটি টাকাও হাতবদল হতো জুয়ার টেবিলে। কেউ কেউ এই জুয়ার আসর থেকে টাকা কামিয়ে কোটিপতি হলেও বেশিরভাগই হারিয়েছে সর্বস্ব।

প্রতিরাতেই লাখ টাকা নিয়ন্ত্রকদের পকেটে
জুয়ার আসরে নিয়মিত অংশগ্রহণকারী একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবাহনী ক্লাবে জুয়ার আসর বসিয়ে ক্লাব কর্তৃপক্ষসহ জুয়ার বোর্ডের নিয়ন্ত্রকরা প্রতিরাতেই পকেটে পুরেছে লাখ টাকার ওপরে। এ কাজের নিয়ন্ত্রক ছিলেন হালিশহরের ব্লি-ব্লকের বাসিন্দা চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সালেহ আহমেদ দীঘল। তার পক্ষে সরাসরি টাকা আদায়সহ দেখভাল করতেন মহিউদ্দিন নামে পটিয়ার এক যুবলীগ নেতা। তার সঙ্গে মিলে সব কন্ট্রাক্টে জুয়ার আসর পরিচালনা ও টাকা আদায় করতেন মনিরুজ্জামান নামে আনোয়ারার আরেক যুবক। দীর্ঘদিন ধরে হালিশহর এসি মসজিদের অদূরেই জুয়ার এই কারবার চললেও এ ক্লাবের সভাপতি ও মহাসচিব সরকারদলীয় প্রভাবশালী দুইজন সংসদ সদস্য হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি নীরব ছিল প্রশাসনও।

যদিও গত বুধবার (১৯ সেপ্টেম্বর) থেকে ঢাকায় ক্যাসিনো ও জুয়াবিরোধী অভিযান চালানোর পর দিন থেকেই বন্ধ হয়ে যায় আবাহনী ক্লাবের এই জুয়ার আড্ডা। সরিয়ে ফেলা হয় জুয়ার সব সরঞ্জাম। তবে গত শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় র‌্যাবের একটি দল অভিযান চালিয়ে সেখানে কিছু না পেলেও দুই প্যাকেট তাসের প্যাকেট পেয়েছিল।

ক্লাবে সবই আছে, নেই শুধু খেলা
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর হালিশহর থানার হালিশহর হাউজিং এস্টেটের জি ব্লকের প্লট এ/২-এ ১১ দশমিক ৭০ বিঘা জমির ওপর ক্লাবটির নিজস্ব স্থাপনাও রয়েছে। তবে সেই জমিতে একটি খেলার মাঠ থাকলেও তা দীর্ঘদিন ধরে খেলার অনুপযোগী। টিনশেডের সেমিপাকা সাত কক্ষের ঘরে খেলোয়াড়দের দাঁড়ানোর জায়গাও নেই। ক্রীড়াসামগ্রী তো নেই-ই। শুধুমাত্র সীমানা প্রাচীরের ভেতর গেটের পাশেই একটি প্রতিকৃতি রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সন্তান শেখ কামালের। মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই ডান পাশে তৈরি করা হয়েছে নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য ব্যারাক। সেখানে পালা করে ১৩ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করে থাকেন সেই শুরু থেকে।

দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের নেতৃত্বে আছেন চট্টগ্রাম আনসার ভিডিপি মহানগর উত্তরের প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল মোত্তালিব। তিনি জানিয়েছেন, ঢাকায় অভিযানের পর থেকে এখানে ক্লাবের সদস্যসহ যারা আগে আসতেন তাদের কেউই আসেন না এখন। তবে ক্লাবের মহাসচিবের নির্দেশ রয়েছে সাংবাদিক ও প্রশাসনের যে কেউ ক্লাবে প্রবেশ করতে চাইলে পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাদের প্রবেশ করার সুযোগ দিতে। তাই পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরই এ প্রতিবেদককে ক্লাবে প্রবেশ করার সুযোগ দেওয়া হয়। দেখা গেছে, চার দিন আগেও সন্ধ্যা হলে যে ক্লাবে আড়াইশ থেকে তিনশ জুয়াড়ির বিচরণে সরগরম থাকতো, সেই ক্লাবে এখন নেমেছে এসে পিনপতন নীরবতা। স্থানীয়রা জানান, মূল নিয়ন্ত্রকের পক্ষে যুবলীগ নেতা দীঘল এই ক্লাবে জুয়ার বোর্ডগুলো দেখাশোনা করে আসছেন। কিন্তু ঢাকায় অভিযানের পর থেকে ক্লাব জুয়ার বোর্ড যেমন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তেমনিভাবে নিয়মিত জুয়াড়িরাও ক্লাবে আর আসছেন না। স্থানীয়দের অভিযোগ, আবাহানী ক্লাব চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা। তবে প্রভাবশালীরা এই ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ স্থানীয়রা।

দায়িত্বরত একাধিক আনসার সদস্যও স্বীকার করেছেন, ক্লাবের ৫১ জন সদস্যসহ তাদের অনেক বন্ধু আবাহনী ক্লাবে জুয়ার আসরে বসতেন। তবে তাদের এখানে মাদকজাতীয় কোন কিছু পান করার সুযোগ ছিল না বলে তারা দাবি করেন। এমনকি কোনও ক্যাসিনোও ছিল না বলে তাদের দাবি।

চট্টগ্রাম আবাহনী লিমিটেড ক্লাবে যে দীর্ঘদিন ধরে জুয়ার আসর চলছে, তার সত্যতা মিলেছে গত ১৯ সেপ্টেম্বর নগরীর পাঁচলাইশ থানায় ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব দিদারুল আলম চৌধুরীর দায়ের করা একটি জিডিতে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘…বর্তমানে হালিশহরস্থ আবাহনী ক্লাবে জুয়ার আসরসহ বিভিন্ন অপকর্মের বিপরীতে ৬ লাখ টাকা আয় হয়।’ দিদারুল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম আবাহনী ফুটবল কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

পাঁচ রুমে বসতো জুয়ার আসর
অনুসন্ধানে জানা যায়, অফিস রুম বাদে অন্য পাঁচটি রুমে বসতো জুয়ার আসর। কয়েকটি রুমে ‘হাজারী’ খেলার জন্য ১৫টি বোর্ড বসানো হতো। প্রত্যেক বোর্ডে চারজন করে মোট ৬০ জন জুয়াড়ি অংশ নিতো। অন্য আরেকটি রুমে ‘তাস’ খেলার টেবিলের প্রতিটিতে চারজন করে ৫০টির বেশি গ্রুপ বসতো। এছাড়াও ‘কাইট’ খেলা ও ‘নাইন কাটে’র জন্য আলাদা দুটি টেবিল ছিল। প্রত্যেকটি গেম শেষে প্রতি টেবিল থেকে টাকা উত্তোলনের দায়িত্বে থাকা মহিউদ্দিন ও মনিরুজ্জামান ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করতো। এরকম প্রতিরাতে তাদের উত্তোলন করা টাকার পরিমাণ হতো সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে ক্লাবের জুয়ার আসার নিয়ন্ত্রক যুবলীগ নেতা দীঘলকে দিতে হতো প্রতি রাতের জন্য একলাখ ত্রিশ হাজার টাকা। সেই টাকার একটা অংশ প্রশাসনকে দেওয়ার পর বড় একটি অংশ যেত ক্লাব কর্তৃপক্ষের কাছে। সেই হিসাবে প্রতিদিন কমপক্ষে লাখ টাকা হলেও ত্রিশ লাখ টাকার একটি তহবিল ক্লাবের তহবিলে যোগ হতো এই জুয়ার আসর থেকে। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট টাকার হিসাব পাওয়া যায়নি।

‘ষড়যন্ত্র’ দেখছেন সরকারদলীয় দুই এমপি
চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দীর্ঘদিন ধরে আবাহনী ক্লাবে রাতভর জুয়ার আসর বসার কথা নিশ্চিত হলেও চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাব লিমিটেডের সভাপতি ও বন্দর-পতেঙ্গা আসনের সংসদ সদস্য এম এ লতিফের দাবি, ‘আগে কোনও সময় জুয়ার আসর বসতো না আবাহনী ক্লাবে। আর যদি জুয়ার আসরই বসার কথা মিডিয়া ও প্রশাসন জানতো এতোদিন তা প্রকাশ করেনি কেন?’

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আমার ক্লাবে জুয়ার আসর বসতো সেটা আমি জানি না আপনি জানেন! আর যদি জানতেন তাহলে এতোদিন নিউজ করেননি কেন? আর প্রশাসনই বা কেন এতোদিন অভিযান চালায়নি।’

ক্লাবটির সভাপতি এম এ লতিফ বলেন, ‘আমাদের ক্লাবে কে জুয়ার আসর বসাতো তার সঠিক তথ্যপ্রমাণ থাকলে পুলিশ বা আপনারা এতোদিন চুপ ছিলেন? কেউ একটা কথা বললেই তথ্যপ্রমাণ ছাড়া দায়ী করা যায় না। আমি তো মনে করি ক্লাব নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ক্লাবের নাম দিয়ে জুয়া মাদক এসব পরিচালিত হোক আমিও চাই না।’

অন্যদিকে ক্লাবটির মূল নিয়ন্ত্রক পটিয়ার সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী বলেছেন, ‘আমাদের ক্লাবে অভিযানে তাসের প্যাকেট পাওয়া গেছে মাত্র। সেখানে তো ক্যাসিনো বা জুয়ার আসর ছিল না। আমার ক্লাবে ক্যাসিনো নেই, জুয়া নেই, মদ নেই। ক্লাবের মহাসচিব হিসেবে মনে করি, এতে সম্মানহানি হয়েছে।’

‘জুয়ার নামে ক্লাবগুলোতে অভিযান মানা যায় না’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রাম ক্লাব, সিনিয়র্স ক্লাব, অফিসার্স ক্লাব সেখানেও তো তাস খেলা হয়। সেখানে তো অভিযান চালানো হয় না।’

ক্রীড়া ক্লাবগুলোর আয়ের উৎস হিসেবে তাস খেলাকে উল্লেখ করে সামশুল হক চৌধুরী আরও বলেন, ‘তাস খেললে বোর্ড মানি দেয় ক্লাবকে। এসব পয়সা ক্লাবের কাজে ব্যবহার হয়। ফুটবল ফেডারেশন বা অন্য কোনো সংস্থা তো ক্লাবকে টাকা দেয় না। এইভাবে যদি অভিযান চালানো হয়, তাহলে লোকজন খেলাধুলা ছেড়ে চলে যাবে।’

আবাহনী ক্লাবের এই দুই শীর্ষ কর্তাই মনে করছেন, জুয়াবিরোধী অভিযানের নামে ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবটিসহ চট্টগ্রামের ক্লাবগুলোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। না বুঝে প্রভাবিত হয়ে ক্লাবের সুনামহানি করতেই এসব অপপ্রচার করা হচ্ছে।

‘সরাসরি ওই এমপি…’
অভিযোগ প্রসঙ্গে জুয়ার বোর্ডের তত্ত্বাবধানকারী সালেহ আহমেদ দীঘল, যিনি চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্যও, তিনি বলেছেন, ‘যুবলীগের রাজনীতি করি বলে মাঝে-মধ্যে ওই ক্লাবে যেতাম। ক্লাবটির নিয়ন্ত্রণ বা অংশীদার কোনোটাই ছিলাম না।’
পটিয়ার সাংসদ ও হুইপ শামসুল হক চৌধুরীকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘ক্লাবটি সরাসরি ওই এমপি পরিচালনা করেন।’ জানা গেছে, ক্লাবের সভাপতি আরেক সাংসদ এম এ লতিফ হলেও মূল নিয়ন্ত্রক শামসুল হক চৌধুরীই।

‘এটা কী ধরনের প্রশ্ন?’
আবাহনী ক্লাবে জুয়ার আসর বসতো কিনা—জানতে চাইলে হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবায়দুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা কী ধরনের প্রশ্ন? এখানে তাস খেলা চলতো সেটা পৃৃথিবীর কে না জানতো। আপনি (প্রতিবেদক) জানতেন না?’

পুলিশও এই জুয়ার আসর থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিতে বলে অভিযোগ রয়েছে—এ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে হালিশহর থানার এই ওসি বলেন, ‘এখানে কারা জড়িত আর কে আছে সেটা যদি জানেন এসব প্রশ্ন কেন করেন? আর জুয়া নিয়ে সিএমপির বর্তমান অবস্থান কী সেটা কি জানেন না?’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এসএম এরশাদ উল্লাহ বলেন, ‘আবাহনী ক্লাব আমার ওয়ার্ডে পড়লেও আমার যাতায়াত সেখানে ছিল না। ক্লাবটি সিনিয়র লোকজনের। তবে সেখানে জুয়া খেলা হতো আগে হালকা পাতলা শুনলেও এখন ঢাকার ঘটনার পর বিষয়টি সবার মুখে মুখে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!