দাঁতের চিকিৎসা নেই চট্টগ্রামের গ্রামে, হাতুড়ের পাল্লায় পড়ে বাসা বাঁধছে ক্যান্সার

পরামর্শের ‘প্রেসক্রিপশন’ দিয়েই খালাস সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

চট্টগ্রাম নগরীর বাইরে উপজেলাগুলোতে দাঁতের রোগীরা চিকিৎসাই পাচ্ছেন না। সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে এলাকার হাতুড়ে দাঁতের ডাক্তারের কাছে শরণাপন্ন হতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। কৃত্রিম দাঁত প্রতিস্থাপন, স্কিলিং, ফিলিং, দাঁত ও মাড়ির রোগের চিকিৎসায় এসব হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে ভুল চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন রোগীরা। আর এই ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত অর্ধশত দাঁতের রোগী ক্যান্সারের ঝুঁকি নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসছেন।

রাঙ্গুনিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দন্ত বিভাগের ডেন্টাল ইউনিট চেয়ার বছরচারেক আগে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। আর এই কারণে সেই থেকে অকেজো হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালটির ডেন্টাল ইউনিট। ৫০ শয্যার উপজেলা এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দন্ত বিভাগে একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা ও একজন টেকনোলজিস্ট রয়েছেন। ডেন্টাল ইউনিট অকেজো থাকায় চার বছর ধরে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দাঁতের সমস্যা নিয়ে আসা সাধারণ রোগীরা। বিভাগটিতে চিকিৎসক থাকলেও যন্ত্রপাতির অভাবে তারা কাজ করতে পারছেন না। ডেন্টাল সার্জারি, ফিলিং, স্কেলিং, দাঁত ওঠানোসহ কোনো চিকিৎসাই মিলছে না সেখানে। রোগীরা এলে তাই রোগীদের কপালে জোটে কেবল ‘পরামর্শ’।

একই অবস্থা চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালেও। এখানে প্রায় সাত বছরের বেশি সময় ধরে ‘অকেজো’ হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ডেন্টাল মেশিন। মেশিনটি পরিত্যক্ত থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে দাঁতের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের। দাঁতের চিকিৎসা বহুলাংশে সার্জারি নির্ভর হওয়ায় মেশিন অকেজো থাকায় দন্তচিকিৎসক থাকার পরেও দাঁতের পরিপূর্ণ চিকিৎসা পাচ্ছেন না বহির্বিভাগে আসা রোগীরা।

শুধুমাত্র রাঙ্গুনিয়া কিংবা দোহাজারী নয়— চট্টগ্রামে গ্রামের রোগীদের দাঁতের চিকিৎসার চিত্র এরকমই বেহাল। জানা গেছে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন করে ডেন্টাল সার্জনের পদ থাকলেও সেসব পদ শূন্য রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। কারণ ওই পদে নিযুক্ত ডেন্টাল সার্জনরা ডেপুটেশনের নামে চলে আসেন শহরে। এদিকে গ্রামের মানুষেরা সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে এলাকার হাতুড়ে দাঁতের ডাক্তারের কাছে শরণাপন্ন হতে বাধ্য হচ্ছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে দন্ত চিকিৎসালয়। রাঙ্গুনিয়া উপজেলা সদরে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে বছরদুয়েক আগে হাতুড়ে ডাক্তার দীপক কুমার শীলের ফ্রেস ভিউ ডেন্টার কেয়ার তালা লাগিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরে হাতুড়ে ডাক্তার দীপক কুমার শীল থেকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে। আর কোনোদিন দাঁতের চিকিৎসা করবে না— এই মর্মে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় দীপককে। এদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দাঁতের চিকিৎসা না হওয়ায় বহাল তবিয়তে চেম্বার খুলে আবারও রোগী দেখছেন দীপক কুমার শীল।

এছাড়াও রাউজানের মুন্সিরঘাটায় হাতুড়ে দন্ত চিকিৎসক সনজিৎ দাশ, কায়েদে আজম নিজেদের ডেন্টাল চিকিৎসক দাবি করে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে চেম্বার তৈরি করে দাঁতের চিকিৎসা করে আসছিলেন। একই দিন তাদের দোকানও সিলগালা করে দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে আবারও চেম্বার খুলে দাঁতের চিকিৎসা দিয়ে আসছেন ওইসব হাতুড়ে ডাক্তার।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক মনজুরে ই মাহমুদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, মফস্বলে দাঁতের চিকিৎসায় হাতুড়ে ডাক্তাররা বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নেন। হাতুড়ে ডাক্তাররা ফিলিং ও নকল দাঁত তৈরিতে সাধারণত ব্যবহার করেন সেলফ কিউর রেজিন নামে এক ধরনের উপাদান— যা মূলত এক ধরনের প্লাস্টিক আইটেম। সুবিধা হচ্ছে, এই উপকরণটি দিয়ে তারা অল্প সময়ে নকল দাঁত তৈরি বা ফিলিং করে দিতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এটা দীর্ঘ সময় ধরে মুখে থাকার কারণে এ থেকে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

ডা. মনজুরে ই মাহমুদ বলেন, এছাড়া এই হাতুড়ে ডাক্তাররা দাঁতের গোড়া অবশ করতে ইথাইল ক্লোরাইড অথবা ফরমাল ডিহাইড নামক কেমিক্যাল ব্যবহার করেন— যা মুখের টিস্যুগুলোকে বার্ন করে দেয়। এ থেকে প্রথমে ঘা হয় এবং পরে সেখানে ক্যান্সার হয়।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল ইউনিটের বহির্বিভাগে প্রতি সপ্তাহেই ৪৫ থেকে ৫০ জন রোগী পাওয়া যায়, যারা দাঁতের রোগে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে ক্যান্সার হওয়ার পর্যায়ে এসে ডেন্টাল ইউনিটে আসেন। এসব রোগীর বেশিরভাগই দাঁতের ক্ষত থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত। আর এসব রোগী আসেন চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। যারা দাঁতের চিকিৎসায় শুরুতেই হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।

বিডিএস ডিগ্রিধারী একজন দন্তচিকিৎসক তার অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘
একজন রোগী প্রথমে আমার কাছে এসেছিল ৫-৬ মাস আগে। আমি বেশ কিছু দাঁতের ফিলিং রুট ক্যানেল ক্যাপ এবং কিছু ভাঙা দাঁতের গোড়া তুলে ফেলতে বলি। রোগী টাকা বাঁচাতে জেনেশুনেই একজন কোয়াক (হাতুড়ে ডাক্তার) এর কাছে কাজ করান। ফলাফল আজ আমার কাছে এসেছেন মাড়ির ব্যথা, ফোলা এবং মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ার সমস্যা নিয়ে। চেকআপ করে দেখলাম রোগীর সমগ্র মুখের মাড়িতে ও দাঁতে এক্রাইলিক দিয়ে লেপে দেওয়া হয়েছে—যা কিনা মুখগহ্বরের ক্যান্সারের একটি প্রধান কারণ।’

এদিকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের মফস্বলের দাঁতের রোগীদের নাজুক অবস্থা জানতে গিয়ে জানা গেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেন্টাল সার্জন না থাকার করুণ চিত্র। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন ডেন্টাল সার্জন থাকার কথা থাকলেও চট্টগ্রাম বিভাগের ৩৫টি উপজেলায় কোনো ডেন্টাল সার্জন নেই।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলার ১৪টি উপজেলার মধ্যে নেই সাতটিতে নেই ডেন্টাল সার্জন। কারণ মফস্বলে পোস্টিং পাওয়া ডেন্টাল সার্জনরা ডেপুটেশনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেন্টাল ইউনিটে চলে আসেন।

এদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট স্থাপন করা হলেও সেখানে কোনো পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ডেপুটেশনে আসা চিকিৎসক দিয়েই চলছে এ ডেন্টাল ইউনিট।

গরির রোগীদের সেবা না দিয়ে ডাক্তারদের ডেপুটেশনে শহরে আসা কতটুকু যৌক্তিক— এমন প্রশ্নের জবাবে ডেপুটেশনে আসা একজন ডেন্টিস্ট বললেন, ‘দাঁতের রোগী দেখার জন্য গ্রামে পড়ে থাকলে দাঁতের ডাক্তার হওয়ার জন্য উচ্চশিক্ষা নেবে কারা?’ কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেলের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডেপুটেশনে আসা চিকিৎসকরা বছরের পর বছর ধরে শহরে থাকার জন্যই এ ইউনিটে কোনো পদ সৃষ্টি করা হয় না।

এদিকে জানা গেছে, গ্রামের ডায়াবেটিস রোগীদের পেরিডেন্টাল ডিজিজের ঝুঁকি খুব বেশি। তাদের দাঁতের গোড়া বা মাঁড়িতে নানা সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গ্রামে চিকিৎসা না পেয়ে এই ধরনের রোগীরা যখন শহরে আসেন চিকিৎসা নিতে, তখন রোগ খারাপের দিকে চলে যায়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ইলিয়াছ চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, যোগদানের পর বিষয়টি নিয়ে আমিও ভেবেছি। কিন্তু বিষয়টার সমাধান অতোটা সহজ না। তারপরও আমরা মন্ত্রণালয়কে জানাবো সমস্যাটি সমাধান করার জন্য।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!