দগ্ধ রোগীতে হিমশিম চমেক হাসপাতাল, শয্যা নেই, বিশেষজ্ঞও একজনই

‘নার্স ওয়ার্ডবয়দের দিলে কি দয়া মায়া নেই’

কান পাততেই শোনা গেল— ‘আমাকে তুলে বসা, আমাকে তুলে বসা’। ওপাশে যেতেই আরেক ধ্বনি— ‘বাতাস করো বাতাস করো, আমার সমস্ত শরীর পুড়ে যাচ্ছে’। পাশেই শোনা যাচ্ছিল কারও করুণ স্বর— ‘মা আমি পারছি না, আমাকে নিয়ে যাও।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ছয় তলার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের ড্রেসিং রুম থেকে এভাবেই ভেসে আসছিল রোগীদের আর্তচিৎকার, কান্নাকাটি ও অসহনীয় যন্ত্রণার আহাজারি। রোগীর যন্ত্রণা সইতে না পারার চিৎকার, পোড়া স্থানে মলমের কড়া গন্ধ— সবমিলিয়ে অবর্ণনীয় এক পরিবেশ বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চমেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে রোগীদের জন্য ২৬টি শয্যা বরাদ্দ থাকলেও রোগীর সংখ্যা ৬০। যার ফলে রোগীদের কিছু জায়গা পেয়েছে শয্যায়। আর বাকিরা ফ্লোর ও বারান্দায়। আগুনে পোড়া রোগীদের উন্নত চিকিৎসার দরকার হলেও চমেকে নেই সেই ব্যবস্থা, নেই কোনো সিঙ্গেল আইসিইউর (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ব্যবস্থা। যেখানে রোগীরা নিজের কষ্ট সহ্য করতে পারছেনা, সেখানে পাশের রোগীদের আহাজারি, চিৎকারে নিজেরাই আধমরা হয়ে উঠছেন। অভিযোগ রয়েছে, নার্স থেকে শুরু করে আয়াদের অবহেলার শিকার হচ্ছেন রোগী ও তার স্বজনরা।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে আছেন একজন বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিশেষজ্ঞসহ চারজন ডাক্তার, ১৭ জন নার্স, ৪ জন আয়া ও ওয়ার্ডবয়। বার্ন ইউনিটে সময় ভাগ করে দায়িত্ব পালন করেন বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. রফিক উদ্দিন আহমেদ, রেজিস্ট্রার ডা. নাফিজ আলম, ডা. সৌম্য দাশ গুপ্ত, ডা. লিটন পালিত, ডা. নারায়ণ চন্দ্র ধর। এছাড়া ২৪ ঘন্টায় ১৭ জন নার্স কাজ করেন রোগীদের সেবা প্রদানে। শেখ মোহাম্মদ (ওয়ার্ড সর্দার), মো. মাসুদ, প্রদীপ চন্দ্র ওয়ার্ডবয় এবং মঞ্জু রানী দাশ আয়ার দায়িত্ব পালন করেন। যা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত নয়।

বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন পতেঙ্গা থেকে আসা জহিরুলের একটিই কথা, ‘মা আমাকে তোলো, আমি আর শুয়ে থাকতে পারছি না।’

জহিরুলের মা ফাতেমা আক্তার দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আজ ১০ দিন ছেলেকে নিয়ে এখানে পড়ে আছি। গাছ কাটতে গিয়ে কারেন্টের শক খেয়েছে। ডাক্তার বলছে, ছেলের শরীরের ৩০ ভাগ পুড়ে গেছে। অনেক ধার দেনা করে চিকিৎসা করাচ্ছি। এই বুড়ো মা-ই আছি ছেলের পাশে, আর কেউ নেই। ছেলে বারবার উঠতে চায়, বসতে চায়। কিন্তু কাউকে ডাকলেও পাই না। কয়েকবার ডাকলে তারা বিরক্ত হয়ে যায়। পোড়া মানুষকে ধরতে চায় না কেউ।’

হাসপাতালের বারান্দায় শয্যায় শুয়ে থাকা সিদ্দিক আহমেদের ছেলে মো. রাফি জানান, ‘গরম তেল পড়ে আমার বাবার পা পুড়ে গেছে, তাই এখানে নিয়ে এসেছি। এখানে এতো রোগী যার কারণে আমার বাবার জন্য সিট পেয়েছি বারান্দায়। কোনো রকম চিকিৎসা চলছে আর কী। এখানে ডাক্তারের চেয়ে নার্সরা গরম বেশি। একবারের বেশি ডাকা যায় না, ঝাড়ি মারে। ওয়ার্ড বয়দেরও সময় মতো পাওয়া দায়।’

আনোয়ারা থেকে আসা বৃদ্ধ ফজল আহমেদ বলেন, ‘মাকে রক্ত পরীক্ষা দিছে, বুঝতেছিলাম না কী দিল, তাই নার্সের কাছে জানতে গিয়েছিলাম, কী ঝাড়িই না দিল। তাদের কি বাবা নাই? মনে কি দয়া মায়া দয়া নাই?’

মোজাহের উদ্দিন নামে একজন বলেন, চমেকের বার্ন ইউনিটে রোগীর তুলনায় সিট কম। এ ধরনের পোড়া রোগীদের কিন্তু আলাদা আলাদা রাখা দরকার। কিন্তু এখানে তো রোগীদের নিচেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যে কোনো সময় ধুলোবালিতে, বাইরের লোকজনের আসা যাওয়াতে, তাদের সঙ্গে আসা জীবাণুতে রোগীদের ইনফেকশন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে প্রচুর। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসব নিয়ে ভাবছেনও না। রোগী আসছে আর ওরা কোনোরকম সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এই আর কী।

বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার রফিক উদ্দিন আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘২৬ বেডের অধীনে ৬০ জন রোগী ভর্তি আছে, যাদের সামলাতে আমাদেরকেই হিমশিম খেতে হয়। সামনে শীতকাল। রোগীর সংখ্যা তখন হয়ে যাবে তিন গুণ। তখন রোগী এবং আরো বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হবে। বেডের চেয়ে রোগী বেশি হওয়ায় রোগীদেরকে ফ্লোরে বেড দিতে হচ্ছে, যেটা কোনোভাবেই মানবিক না। কিন্তু করার কিছুই নেই। নিচে সিট দেওয়ার কারণে রোগীদের আমরা যতই ভালো সেবা দিয়ে থাকি না কেন, তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি না। কারণ তাদের মাথায় এই ধারনা নিয়ে রাখে যে, ফ্লোরে সিট পেয়েছে সেখানে কি আর ভালো সেবা দেবে?’

তিনি আরো বলেন, ‘বার্ন ইউনিটে জনবলের বড় অভাব। যা জনবল আছে, তা দিয়ে এক শিফটের ডিউটিতেই হয় না। এক শিফটেই ১২ জন দরকার। কিন্তু বর্তমানে যা ব্যবস্থা আছে তা জোড়াতালি দিয়ে চলার মতো।’

রোগীদের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, ‘বৈদ্যুতিক শক খাওয়া বা আগুনে পোড়া— দুটোই পুড়ে যাওয়া। কত ভাগ পুড়ে গেলে একজন রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে না সেটা বলা দায়। কারণ অনেক রোগী আসে বৈদ্যুতিক শক লাগা। যাদের শরীরে ১০ ভাগও পুড়ে না। কিন্তু বাঁচাতে পারি না। কারণ তাদের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়। আবার অনেকে আছেন ৪০-৪৫ ভাগ পুড়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। তবে পুড়ে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসাসেবা অন্য রোগীর তুলনায় খুবই স্পর্শকাতর। মূলত নিয়ম হচ্ছে বার্ন ইউনিটে রোগীদের সিঙ্গেল আইসিইউতে রাখা। কারণ ধুলোবালিতে তাদের ক্ষত স্থানে ইনফেকশন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া ওয়ার্ডে অন্যান্য রোগীদের চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজেও রোগী দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু আমরা রোগীদের সেই সেবা এখানে দিতে পারছি না। একই ওয়ার্ডেই ওপরে-নিচে রোগীদের সেবা দিয়ে যেতে হচ্ছে। বেশি গুরুতর রোগীদের আমরা ঢাকা পাঠিয়ে দিই।’

এ নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক আখতারুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ‘সব ইউনিটেই বেডের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু এতো রোগী সে তুলনায় আমাদের প্রচুর জনবল সংকট রয়েছে। ফলে কিছুই করার নেই আমাদের। মন্ত্রণালয় অনুমোদন না দিলে লোকবল কিভাবে নিয়োগ দেবো? তাছাড়া বার্ন ইউনিটের কাজ সাংঘাতিক পরিশ্রমের কাজ। যার কারণে ডাক্তার, অন্যান্য কর্মীরা ওই ইউনিটে কাজ করতে চান না। বার্ন ইউনিটে একজনই বার্ন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যাকে দিয়েই আমাদের বার্ন ইউনিট চালাচ্ছি। উনাকেও ঢাকা নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, আমি বাধা দিচ্ছি। একজন বার্ন বিশেষজ্ঞ আছেন, তিনিও যদি চলে যান তাহলে তো বার্ন ইউনিটে বন্ধ করে দিতে হবে।’

রোগীদের উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বার্ন ইউনিটে রোগীদের উন্নত চিকিৎসার দরকার সেটা জানি। কিন্তু সিঙ্গেল আইসিইউ সিস্টেমের ব্যবস্থা এখানে সম্ভব না। ওয়ার্ডের দায়িত্বে একজন মাত্র বিশেষজ্ঞ। বাকি যে ৪ জন রয়েছেন তারা কখনো মেডিসিনে, কখনো অন্য ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালন করছেন। সেখানে আমরা আইসিইউর ডাক্তার কই পাবো? আইসিইউর পরিশ্রম তো আরো মারাত্মক। আইসিইউতে দায়িত্বরত ডাক্তারদের চেহারা পাল্টে যায় পরিশ্রমে। যার কারণে সারাদেশেই এসব বার্ন বিশেষজ্ঞের খুবই সংকট। সারাদেশে মনে হয় ২০ বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। ঢাকায় ৫০০ শয্যার ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে’ ২৩২ জন বার্ন বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। কিন্তু সেটা সম্ভব না। যার কারণে ১০ বছরেও এটা পুরোপুরিভাবে চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আসলে সবাই আরামপ্রিয়— ডাক্তারাও চায় যে সুন্দর সুন্দর শার্ট প্যান্ট পড়ে আসবেন, এন্ডোসকপি করবেন— এতো এতো কষ্টের কাজগুলো করতে চান না।’

ডাক্তার যদি এতো আরাম খোঁজে রোগীরা কোথায় যাবে— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সেটাই তো চিন্তা করছি। ডাক্তারের প্রচুর সংকট রয়েছে, ডাক্তার দরকার। সরকারের উচিত এসব বিভাগে কিছু ডাক্তার জোর করে পাঠানো। মেডিসিন বিষয়ে সিট কমিয়ে দিলে, এমনিতেই অনেক স্টুডেন্ট এসব বিষয়ে পড়তে বাধ্য হবে। তখন ক্যান্সার, বার্ন, সার্জারি, রেডিওলজি, এনেস্থেসিয়া এই বিভাগগুলোতে আর ডাক্তারের সংকট থাকবে না।’

নার্স-আয়াদের বিরুদ্ধে রোগীদের অবহেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জনবল কম, তার ওপর এতো পরিশ্রম হয় বার্ন ইউনিটে। যার কারণে হয়তো তারা মাঝে মাঝে বিরক্তি প্রকাশ করে। তবে আমরা চেষ্টা করছি লোকবল বাড়ানোর। নতুন বিল্ডিং বানিয়ে লাভ নেই বাড়াতে হবে জনবল।’

এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!