‘তেল সরবরাহে পাইপ লাইন পরিবেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে’

জ্বালানি তেল সরবরাহের জন্য ঢাকা চট্টগ্রাম পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পরিবেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। সেই সাথে পথে বসে যাবে তেল পরিবহনের সাথে সম্পৃক্ত লাইটার জাহাজ মালিক এবং শ্রমিকরা। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে সরকারকে পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি বিবেচনায় আনা উচিৎ।

‘তেল পরিবহনে ঢাকা- চট্টগ্রাম পাইপলাইন: অর্থের অপচয় ও পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা।

চট্টগ্রাম সিনিয়রস ক্লাবের হল রুমে শনিবার ( ২১ সেপ্টেম্বর) সকালে অ্যালায়েন্স ফর কনসার্ন সিটিজেন এই বৈঠকের আয়োজন করে। বৈঠকে সঞ্চালনা করেন দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত।

আলোচনা সভায় বক্তরা বলেন, ওয়াসার পাইপ লাইন লিকেজ হয়ে পানির অপচয়ের ঘটনায় প্রায়শই ঘটে। এছাড়া লাইন ফুটো করে পানি চুরির ঘটনাও কম নয়। এই বাস্তবতায় তেল সরবরাহের জন্য পাইপ লাইন লিকেজ কিংবা নাশকতার উদ্দেশ্যে কেটে দিলে সেটি পরিবেশের জন্য মহা বিপদ ডেকে আনবে। হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে তেল সরবরাহের জন্য পাইপ লাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে বরং রেল এবং নদীপথে তেল সরবরাহ আরো কিভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে সরকার উদ্যোগী হলে এই খাত আরো সমৃদ্ধ হবে।

অনুষ্ঠানে ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘ঢাকা চট্টগ্রাম পাইপ লাইন লাইন প্রকল্পের মধ্য দিয়ে শুধুমাত্র এক ধরনের তেল পরিবহন সম্ভব। তাছাড়া এই লাইন দিয়ে শুধু চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত তেল যাবে। অথচ নদীপথে সবধরনের তেল পরিবহন সম্ভব। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে একদিকে যেমন পরিবেশের জন্য অশনি সংকেত তেমনি ভাবে বেকার হয়ে যাবে নৌ-পরিবহনের সাথে সম্পৃক্ত হাজার হাজার শ্রমিক। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার আগে এর সম্ভাব্যতা সঠিকভাবে যাচাই করতে হবে।’

তেল-গ্যাস- খনিজ সম্পদ ও বন্দর বিদ্যুৎ রক্ষা জাতীয় কমিটি চট্টগ্রাম এর সদস্য সচিব প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার তার বক্তব্যে বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত তেল সরবরাহের এই লাইন সফট সয়েলের উপর দিয়ে যাবে। ভুমিকম্পপ্রবণ এই অঞ্চলে পাইপলাইনটির কারনে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশংকা তৈরি হবে। তাছাড়া বহির্বিশ্বের শত্রুর চেয়ে আমাদের দেশের শত্রুর সংখ্যাও কম নয়। রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরির লক্ষ্যে যদি এই পাইপলাইনের ক্ষতি সাধন করে তাহলে সেটি পরিবেশের জন্য মারাত্বক বিপদ বয়ে আনবে।

পরিবেশবাদী সংগঠন পিপলস ভয়েস চট্টগ্রামের সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, চট্টগ্রামে অনেকগুলো ফ্লাইওভার সেভাবে কাজে আসছে না। হাজার কোটি টাকার জলাবদ্ধতা প্রকল্পটিও কতটুকু কাজে আসবে সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে। তেল সরবরাহে ঢাকা চট্টগ্রাম পাইপলাইন প্রকল্পটিতে জনগনের মতামতের প্রতিফলন হয়নি। প্রকল্পটি রাষ্ট্রকে হুমকিতে ফেলবে। যেখানে শহরে পানির লাইন চুরি হয়ে ওয়সার পানি স্রোতের মতো প্রবাহিত হয় সেখানে তেল সরবরাহের এই লাইন ফুটো কিংবা চুরি হলে সেই তেল মাটির সাথে মিশে গিয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়াবে।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, পদ্মা মেঘনা যমুনার সিবিএ নেতারা লুটপাট করে এই প্রতিষ্ঠানটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) একটি অদক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর দুর্নীতিবাজ লোক দিয়ে পরিচালিত হয় জ্বালানি মন্ত্রণালয়। নাইজেরিয়া এবং সুদানে পাইপলাইন দুর্ঘটনায় বহু লোকের প্রাণহানি হয়েছে।

রেলকে অপদার্থ অদক্ষ সেক্টর উল্লেখ করে মাহফুজুল হক শাহ বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যকর করা যায় তাহলে চট্টগ্রাম থেকে সারাদেশে তেল পরিবহনে গতি আসবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এ বিএম আবু নোমান বলেন, পাইপলাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে এর সাথে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করা হয়নি। পাইপলাইন নির্মাণের পরবর্তীতে কিভাবে এর রক্ষণাবেক্ষণ হবে সেটিরও উল্লেখ নেই। এই প্রকল্পের কারণে নৌ-পরিবহনের হাজার হাজার লোক বেকার হবে, তাদের হয়তো বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করা যাবে কিন্তু পরিবেশের যে ক্ষতি হবে সেটি কোনভাবেই পুষিয়ে আনা সম্ভব নয়।

গোলটেবিল বৈঠকে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সচেতন নাগরিক কমিটি চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ, লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি শেখ মো. ইসা, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাদাত হোসেন, পদ্মা অয়েল ট্যাংকার ওনার্স রিপ্রেজেন্টেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. এয়াকুব চৌধুরী, পদ্মা অয়েল ট্যাংকার ওনার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন চৌধুরী শামীম, যমুনা অয়েল ট্যাংকার মালিক সমিতির মফিজুল হক, দৈনিক বনিক বার্তার সিনিয়র রিপোর্টার সুজিত সাহা প্রমুখ। এতে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক ভোরের কাগজের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান সমরেশ বৈদ্যসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা।

উল্লেখ্য কমসময় ও খরচে এবং নিরাপদে জ্বালানি তেল সরবরাহের জন্য ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর ‘চট্টগ্রাম হতে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক। এ প্রকল্পে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত ২৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপ লাইন বসবে। দুই হাজার ৮৬১ কোটি টাকার এই প্রকল্প ২০২০ সালের মধ্যে এই বাস্তবায়ন করার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার।

এসসি/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!