তুচ্ছ অভিমানেই চট্টগ্রামে মেয়েরা বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ

দেশে বছরে ১০ হাজার প্রাণ যাচ্ছে আত্মহননে

অভিমান! তুচ্ছ কারণে আচমকা সেই অভিমানের পাল্লাটা হয়ে ওঠে ভারী। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যায় মুহূর্তেই। অভিমান থেকে একসময় আত্মহত্যা। যে বিষয়টি মামুলি তর্কের, ঝগড়া কিংবা সাধারণ মনোমালিন্যের— সেটিই টেনে নিয়ে যাচ্ছে চূড়ান্ত আত্মহননের দিকে।

চলতি বছর চট্টগ্রামে যে কয়জন তরুণী-কিশোরী আত্মহত্যা করেছেন, সেগুলোর নেপথ্যের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সবগুলোর পেছনেই আছে তুচ্ছ সব কারণ। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুগের হাওয়ায় ভেসে অনেকেই এখন ফেসবুককেন্দ্রিক নানা ঘটনা, ইউটিউবে ছড়ানো নানা ভিডিও দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন। নিজেকে সেসব ঘটনার মাঝে দাঁড় করিয়ে একসময় কল্পনায় অন্যকে দেখে নেওয়ার ছক তৈরি করেন নিজেকেই শেষ করে দিয়ে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময় এসেছে এসব নিয়ে ভাবার, জানার এবং জানানোরও। তবে সবখানেই নারীদের আত্মহত্যার পিছনে সব থেকে বড় কারণ পারিবারিক অশান্তি।

৭ বছর বয়সী বোনের সঙ্গে মোবাইলে ভিডিও দেখা নিয়ে ঝগড়া। আর তুচ্ছ সেই ঝগড়া থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন নবম শ্রেণির ছাত্রী মিশু। শুক্রবার (১১ ডিসেম্বর) নগরীর খুলশী থানাধীন ঝাউতলা রেলওয়ে কলোনির ৪ নম্বর ভবনের দ্বিতীয় তলায় সানজিদা আক্তার মিশু নামের এই কিশোরী আত্মহত্যা করেন।

এরকম তুচ্ছ কারণে নিতান্তই অভিমানে পড়ে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় চলতি আত্মহত্যার বেশ অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর অন্তত ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

হালিশহরের বাসিন্দা মাহির স্বপ্ন ছিল মডেলিং করে ক্যারিয়ার গড়ার। এই স্বপ্ন নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের একটি কথিত ‘মডেলিং এজেন্সি’র সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সেই তরুণী হঠাৎই নিজের বাসায় আত্মহত্যা করে বসলেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে নিজের রুমের ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেন ১৯ বছরের এই তরুণী। মাহি নগরীর একটি কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। ‘মডেলিং’য়ের সূত্রে এসময় নাসিরাবাদ এলাকার এক ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন মাহি— এমন কথা নিশ্চিত করে উইন্ডোজ মাল্টিমিডিয়া নামের ওই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত এক তরুণ জানান, ‘সম্প্রতি সেই সম্পর্ক ভেঙে গেছে বলে আমরা শুনেছি।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাহির ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু জানান, ‘শোবিজ মিডিয়ায় অবস্থান পাকাপোক্ত করতে গিয়ে মাহি একপর্যায়ে মাদকসেবনের সাথে জড়িয়ে যায়। তার সঙ্গে কয়েকটি ছেলের সম্পর্কও ছিল। তার পরিবার বিষয়টি টের পেয়ে তাকে ঘরের বাইরে যেতে দিতো না।’ তবে মাহির মামা ঢাকার ডেমরা থানার ওসি তদন্ত মো. সেলিম বলেন, ‘মাহি এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। খুব শান্ত ও ভালো মেয়ে। রাগটা একটু বেশি। আমার বাবার (মাহির নানা) কাছে বান্ধবীর বাসায় যেতে দিতে বলেছিল। কিন্তু তার বাবা করোনার মধ্যে ঘরের বাইরে যেতে মানা করার পর সে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। এর একপর্যায়ে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। পরে কোনও সাড়া না পেয়ে পরিবারের অন্যরা দরজা ভেঙে দেখে মাহি ফ্যানের সাথে ঝুলছে।’

গত ২৯ নভেম্বর নগরের আকবরশাহ থানার কালিরহাটে তানজিলা আক্তার লিজা (১৩) নামে এক কিশোরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।

৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার পদুয়া ইউনিয়নে খুরশিদা বেগম (৪৮) নামে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। আগের দিন রাতে তার ভাইবোনদের সাথে ঝগড়া হয় খুরশিদার।

২৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার গোমদণ্ডী ফুলতলা এলাকায় সুমাইয়া আক্তার নামে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থী বাসার ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

২২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে এনজিওর কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পেরে রুপনা শর্মা (৩৮) নামের এক গৃহবধূ নিজ ঘরে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। পরিবারের অভিযোগ, আগে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করলেও করোনা মহামারির কারণে স্বামীর নিয়মিত কাজ না থাকায় সঠিক সময়ে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন রুপনা শর্মা। পরে সরকারিভাবে ঋণের কিস্তি সংগ্রহে বিধি-নিষেধ আসায় রুপনা শর্মা আর কোনো কিস্তি দিতে পারেননি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরে রুপনা শর্মাকে প্রতিদিন কিস্তি দিতে হতো। প্রায় ৮ লাখ টাকা কিস্তি ও ঋণ থাকায় মানসিক চাপে তিনি একপর্যায়ে আত্মহত্যা করেন।

২৭ জুলাই রাতে চন্দনাইশ উপজেলার দক্ষিণ গাছবাড়িয়া পৌরসভার হরিণারপাড়া এলাকায় ফাতেমা তুজ জোহরা (১৪) নামের এক স্কুল ছাত্রী ছোট্ট বোনের সাথে ঝগড়ার জের ধরে ঘরের একটি রুমে ওড়না প্যাঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। সে গাছবাড়িয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। জানা যায়, রাতে ফাতেমাতুজ জোহারা ঘরের একটি আলাদা রুমে প্রতিদিনের মত এশার নামাজ পড়তে যায়। নামাজ শেষ করে না আসায় ১১টার দিকে ভাত খাওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যরা তাকে ডাকতে গেলে গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় ঘরের বীমের সাথে ফাতেমাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়।

২১ জুলাই নগরীর বাকলিয়ার দেওয়ানবাজার এলাকায় গলায় ওড়না প্যাঁচিয়ে নীলম ধর অর্পা (২৩) নামে অরেক তরুণী আত্মহত্যা করেন। অর্পা পরিবারের সঙ্গে দেওয়ানবাজারের জালাল কলোনিতে থাকতেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী ছিলেন। মাস্টার্স করেন ২০১৯ সালে। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও তাকে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট দিতে দেখা যায়।

১৯ জুলাই নগরীর কোতোয়ালী থানার ব্রিকফিল্ড রোডের একটি বাসা থেকে বৃষ্টি মুন্ডা (১৪) নামের এক কিশোরী গৃহকর্মীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রায় চার বছর ধরে ওই বাসাটিতে কাজ করতেন তিনি। কাজের জন্য বৃষ্টিকে ‘বকা’ দেয়ায় তিনি ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন বলে পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন।

২৫ জুন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটেরখীল এলাকায় মানসিক ভারসাম্যহীন এক কিশোরী তানিয়া আক্তার (১৫) নিজ ঘরে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন।

২৭ মে মিরসরাইয়ের দক্ষিণ ওয়াহেদপুর গ্রামে বাবা ঈদের সালামি না দেওয়ায় অভিমান করে ফ্যানের সাথে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে মাইমুনা আক্তার নামে (১৫) এক অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। পরিবারের সদস্যরা জানান, মাইমুনার বাবা ছোট দুই ভাই-বোনকে ঈদ সালামি দেন ২০০ টাকা। মায়ের কাছে তখন সে জানতে চায় তার জন্য দিয়েছে কিনা? দেয়নি শুনে ঘরের ভেতর গিয়ে দরজা বন্ধ করে সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে মেয়েটি।

১৯ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানা এলাকায় চট্টগ্রামের উঠতি মডেল মানজুমা পারভীন মুনা নিজ বাসায় গলায় ওড়না প্যাচিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি ২০১৮ সালে ‘মিস হ্যামার স্ট্রেংথ’ নামে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন।

চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি নগরীর ডবলমুরিং থানার শেখ মুজিব রোডে গলায় ফাঁস দিয়ে সুমাইয়া জেসিন (২৬) নামে এক তরুণী আত্মহত্যা করেন। বিয়ের দুই বছরের মাথায় সুমাইয়ার ডিভোর্স হয়। এরপর তিনি বাবার বাসায় চলে আসেন। সেই থেকে বিভিন্ন সময় বাসায় মা-বোনদের সাথে তার ঝগড়া লেগেই থাকতো। এরকম মানসিক অশান্তির জের ধরে অভিমানে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না ঝুলিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তিনি। গুরুতর আহত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

কেন এই আত্মহত্যার প্রবণতা— বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল জানাচ্ছেন, ‘মানব মস্তিস্কের সেরিব্রোস্পাইনাল তরলের মধ্যে ‘৫-হাইড্রোক্সি ইনডোল অ্যাসেটিক অ্যাসিড’ নামের একটি রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ কমে গেলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। আত্মহত্যা করার জন্য প্রথমে বিক্ষিপ্তভাবে মনের মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা আসে। এরপর বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলো বারবার আসতে থাকে। ব্যক্তি এই চিন্তা থেকে সহজে মুক্ত হতে পারে না। আত্মহত্যার চিন্তা তার স্বাভাবিক কাজকর্মের ওপর প্রভাব ফেলে এবং তার আত্মহননের ইচ্ছা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। সে ভাবে— ‘কেন আমি বেঁচে থাকব?’ একসময় তার মনে হয় এখনই তার মরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত সময়। সে কখনো আবেগতাড়িত হয়ে, আবার কখনো পরিকল্পিকভাবে মৃত্যুচেষ্টা করে। সফল না হলে তার মধ্যে আবার বিক্ষিপ্তভাবে আত্মহত্যার চিন্তা আসতে থাকে। এই চক্রটি বারবার হতে পারে।’

এ চক্রটি থেকে কিভাবে বের হয়ে আসা যায়— এরও উত্তর দিয়েছেন ডা, আহমেদ হেলাল। তিনি জানাচ্ছেন, ‘আত্মহত্যার ইচ্ছা একটি ভুল মানসিক প্রক্রিয়া— এটি যে কোনো অপমান বা অন্যায়ের প্রতিবাদ নয়, সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।’

আইএমই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!