তিনজনের হাতে পটিয়া আওয়ামী লীগের ঘুঁটি, অন্তর্কোন্দলে ধুঁকছে তৃণমূল

বিভক্ত হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ। তিন নেতার হাতেই এখন দলের চাবিকাঠি। দলীয় প্রভাব ও স্থানীয় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই তিন নেতার রয়েছে তিনটি গ্রুপ। দলীয় অন্তর্কোন্দলে উপজেলায় ১৭টি ইউনিয়নের মধ্যে নৌকা বিজয়ী হয়েছে ১৩টিতে। আর ৪ ইউপিতে বিজয়ী হয়েছেন নৌকার বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী। গ্রুপিংয়ের ফলে ঘটছে সহিংসতার ঘটনাও।

গ্রুপ তিনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপি, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম এবং বিজিএমইএ সাবেক সহ-সভাপতি ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মোহাম্মদ নাছির। তবে এর মধ্যে হুইপ সামশুল হকের গ্রুপটির প্রভাব প্রায় একচ্ছত্র।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সামশুদ্দীন আহমেদ ও আবদুল মতিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ছিল পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ। এরপর দুই বছর ছিল আহ্বান কমিটির কাঁধে ভর করে। তারপর ২০০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আবুল কালাম আজাদ ও সামশুদ্দীন আহমেদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এরপর ২০০৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সামশুদ্দীন আহমেদ ও বিজন চক্রবর্তীর দখলে ছিল। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রাশেদ মনোয়ার ও নাছির উদ্দিন ছিলেন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে। এরপর ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম সামশুজ্জামান চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক হারুনুর রশিদের নেতৃত্বে চলছে।

আরও জানা যায়, রাশেদ মনোয়ার ও নাছির উদ্দিনের সময় ২০১৭ সালে নামকাওয়াস্তে সম্মেলনের মাধ্যমে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করে তার অনুসারী আ ক ম সামশুজ্জামান চৌধুরীকে সভাপতি ও অধ্যাপক হারুনুর রশিদকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করেন। কারণ রাশেদ মনোয়ার ও নাছির উদ্দিন ছিলেন বিজিএমইএ সাবেক সহ-সভাপতি এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মোহাম্মদ নাছিরের অনুসারী। যদিও রাশেদ মনোয়ারকে পরে চলে গেছেন হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর দলে। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন আছেন বিজিএমইএ নেতা মোহাম্মদ নাছিরের গ্রুপে।

সেই সম্মেলনের পর থেকেই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ তিন দলে বিভক্ত হয়। এরপর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বদিউল আলম একটি গ্রুপ তৈরি করে সক্রিয় হয়ে ওঠেন পটিয়ায়।

এদিকে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপির গ্রুপে আছেন সাবেক সাংসদ চেমন আরা তৈয়ব, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম সামশুজ্জামান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক হারুনুর রশীদ, জেলা পরিষদের সদস্য দেবব্রত দাশ দেবু, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রদীপ দাশ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রাশেদ মনোয়ার, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, ভাইস চেয়ারম্যান তিমির বরণ চৌধুরী, মাজেদা বেগম শিরু, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আলমগীর আলম, সাধারণ সম্পাদক এম এন এ নাছির, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা বিজন কুমার চক্রবর্তী, অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ, আইয়ুব আলী ও নুরুল হাকিম।

কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলমের গ্রুপে আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দীন আহমেদ, মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম আবদুল মতিন চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, অ্যাডভোকেট বদিউল আলম, মাস্টার সিরাজুল ইসলাম, উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ডি এম জমির উদ্দিন, ইউনুস মেম্বার, কাজী মোরশেদ, জসিম উদ্দিন, হারুন, ধলঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রনবীর ঘোষ টুটুন, মুক্তিযোদ্ধা নুরুচ্ছফা, মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, প্রকৌশলী জসিম উদ্দিন, সোহেল ইমরান, আলমগীর আলম, সাইফুল ইসলাম সাইফু, আবু ছৈয়দ, রফিক আহমদ, সাইফুদ্দিন ভোলা, শাহজাহান চৌধুরী, কাজী আবু জাফর, জাহাঙ্গীর আলম।

অন্যদিকে বিজিএমইএ সাবেক সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাছিরের গ্রুপে আছেন জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ জাফর, সেলিম নবী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন, মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম, মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক, এমএ মতিন চৌধুরী, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সৈয়দ, মুক্তিযোদ্ধা কাজী আবু তৈয়ব, মোজাহের আলম চৌধুরী, জয়নাল আবেদীন, সবুজ বড়ুয়া, নাজিম উদ্দীন, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এম মাঈনুদ্দীন, মাখন চৌধুরী, এস এম পারভেজ, সৈয়দ তালুকদার, আশিষ তালুকদার, মহিউদ্দিন মহি, হাসিনা আকতার, প্রতিমা চৌধুরী, রোকেয়া বেগম, প্রসুতি বড়ুয়া, উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা মোবাশ্বের আলম।

এদিকে পটিয়া উপজেলায় এই তিন গ্রুপ জাতীয় দিবসসহ অনুসারীদের নিয়ে পৃথক পৃথকভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে। এমনকি উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌর এলাকায় ও এভাবে চলছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।

তৃণমূলের একাধিক নেতা-কর্মী জানান, গ্রুপিং হলে সবাই চেষ্টা করে সন্ত্রাসী ও অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে নিজেদের গ্রুপ ভারী করতে। এর ফলে সহিংসতা হয়। যা বর্তমানে পটিয়ার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে।

হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপির অনুসারী এবং জেলা আওয়ামী লীগ নেতা বিজন চক্রবর্তী বলেন, বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি জেলা অনুমোদিত বৈধ কমিটি। তাদের নেতৃত্বে উপজেলাজুড়ে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে। রাজনীতিতে গ্রুপিং থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সেটা যেন সুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে হয়। সামনে নির্বাচন সবাই তো দলের মনোনয়ন চাইতে পারে।

জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও বিজিএমইএ নেতা মোহাম্মদ নাছিরের অনুসারী সেলিম নবী বলেন, পটিয়ায় আওয়ামী লীগ সুসংহত। তবে অনুপ্রবেশকারীসহ কিছু সুবিধাভোগী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী বর্তমান এমপির সঙ্গে আছে, যারা বিভিন্ন কিছু দখলসহ চাঁদাবাজিতে সবসময় লিপ্ত।

যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলমের অনুসারী সাবেক ছাত্রনেতা জসিম উদ্দিন বলেন, পটিয়ায় আওয়ামী লীগ আছে বলে আমি মনে করি না। ২০১৭ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠনের পর আজও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, হুইপ সামশুল হক চৌধুরী তার অনুসারীদের নাম প্রকাশ করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গায়ের জোরে ঘোষণা দেন। যেটার জেলা আওয়ামী লীগের কোনো অনুমোদন নেই। এরপর তারা ১৪টি ইউনিয়নের বৈধ কমিটি ভেঙে দিয়ে তোপের মুখে পড়েন। আজ পর্যন্ত পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ কোনো বর্ধিত সভা করতে পারেনি। আমি মনে করি, পটিয়ায় আওয়ামী লীগ মরে গেছে।

পটিয়া উপজেলা সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন বলেন, আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটি একপেশে। যতটুকু জেনেছি কমিটি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান এর অনুমোদন দেননি। এছাড়া কমিটির মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। উপজেলা কমিটি কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ। অবিলম্বে কমিটি ভেঙে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি করা হোক। পটিয়াতে আমরা এমপি লীগ চাই না, কার্যকর আওয়ামী লীগ চাই।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!