তরুণ আফিফ হোসেন ‘ধ্রুব’তারা হয়ে বাংলাদেশকে জেতালেন

ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের শুভসূচনা

আফিফ। পুরো নাম আফিফ হোসেন ধ্রুব। নিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচেই জ্বললেন ধ্রুবতারা হয়ে। সাথে ছিল নবম টি-টোয়েন্টি খেলতে নামা মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। সৈকত আর ধ্রুব মিলে মান বাঁচালেন দেশের। দলের ‘নামীদামী’ সব ব্যাটসম্যানের ব্যর্থতার পর হাল ধরেন তারা। তাদের দারুণ ব্যাটিংয়েই প্রায় হেরে বসা ম্যাচটি রূপ নিল থ্রিলারে। ৭ম উইকেটে দুজন উপহার দেন ৮২ রানের ম্যাচ বাঁচানো এবং ম্যাচ জেতানো জুটি। এতেই ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়েকে ৩ উইকেটে হারিয়ে মান বাঁচল বাংলাদেশের। কারণ মাত্র ৬০ রানেই ৬ উইকেট হারিয়েছিল স্বাগতিকরা। ততক্ষণে প্যাভিলিয়নের আরাম কেদারায় তারকাসব ব্যাটসম্যানরা।

২৯ রানে ৪ উইকেট। সাকিব আল হাসানও আউট। খানিকবাদে ৬০ রানে নেই ৬ উইকেট। সাব্বির রহমানও মাথা নিচু করে ফিরে গেলেন। পুরো ম্যাচে তখন জিম্বাবুয়ের দাপট। কড়া নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু এমন ম্যাচও জিতে নিলো বাংলাদেশ ৩ উইকেটে। দলকে জেতালো মাত্র একটি জুটি। আফিফ হোসেন ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের ৪৬ বলে ৮২ রানের জুটি বাংলাদেশকে এনে দিল অনেক স্বস্তির এক জয়। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেই ম্যাচ জয়ী ইনিংস খেললেন উনিশের এই তরুণ! ২৪ বলে তার হাফসেঞ্চুরির ইনিংস জানিয়ে দিলো এই ছেলে জাতীয় দলে অনেকদিন খেলার জন্যই এসেছে।

টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক ম্যাচের প্রথম বলেই উইকেটের দেখা পান তাইজুল ইসলাম।কিন্তু ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলে সব আলো কেড়ে নিলেন আফিফ।
টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক ম্যাচের প্রথম বলেই উইকেটের দেখা পান তাইজুল ইসলাম।কিন্তু ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলে সব আলো কেড়ে নিলেন আফিফ।

শুরুর ছয় অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান মাত্র ৬০ রানে ফিরে যাওয়ার পর এই ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়েছিলো বাংলাদেশ। তরুণ আফিফের ব্যাট দলকে নতুন করে পথ দেখালো। একপাশে সিনিয়র সদস্য মোসাদ্দেক এবং অন্যপ্রান্তে আফিফ-এই দুই ব্যাটসম্যান বাংলাদেশকে জেতালেন।

কথা ছিল সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল) খেলতে যাবেন আফিফ। কিন্তু সেটি হয়নি বাংলাদেশ দলের টিম ম্যানেজমেন্টের চাওয়ায়। ইমার্জিং দলের হয়ে রানের মধ্যে থাকায় আফিফ হোসেন ধ্রুবকে ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজের দলে রেখে দেন নির্বাচকরা। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে প্রথম বাজিমাত করলেন ১৯ বছরের এই তরুণ। নিজেদেরকে বাহবা দিতেই পারেন বাংলাদেশের নির্বাচকরা।

মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকে সঙ্গে নিয়ে ধ্বংসস্তুপ থেকে বাংলাদেশকে লজ্জা থেকে বাঁচান আফিফ। বৃষ্টির কারণে ১৮ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে জিম্বাবুয়ে তোলে ১৪৪ রান। জবাবে ১০ ওভারে ৬৫ রানে ৬ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। শেষ ৮ ওভারে ৮০ রানের কঠিন সমীকরণের সহজেই পাড়ি দেন দুই তরুণ মিলে। মোসাদ্দেক ২৪ বলে ৩০ রানে অপরাজিত থাকেন। থেকে যায় দুটি বল।

একাদশ ওভারে বাঁহাতি স্পিনার শিন উইলিয়াসমকে দুটি চার ও এক ছয় মেরে ম্যাচের চিত্র বদলাতে থাকেন আফিফ। পরের ওভারে মোসাদ্দেক টানা দুই ছক্কার চোখ রাঙানিতে দুর্বল হতে থাকে জিম্বাবুয়ে। দারুণ রসায়নে চলতে থাকে শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে দুই তরুণের ছুটে চলা। আফিফের বিদায়ে ৮২ রানের জুটি ভাঙার পর উইনিং শট খেলেন সাইফউদ্দিন।

টস জিতে আগে বোলিং বেছে নেয়া বাংলাদেশ জিম্বাবুয়ে ব্যাটসম্যানদের ১৫ ওভার পর্যন্ত রেখেছিল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে। ১৫ ওভার পর্যন্ত বাংলাদেশের সীমার মধ্যেই ছিল। কিন্তু সাকিব আল হাসানের একটা ওভারই পাল্টে দিল হিসাব। অধিনায়কের করা ১৬তম ওভারে ৩০ রান নিয়ে টাইগারদের সামনে ১৪৫ রানের লক্ষ্য দেয় জিম্বাবুয়ে।

অথচ একটা সময় মনে হয়েছিল জিম্বাবুয়েকে অল্প রানে আটকে দিয়ে ত্রিদেশীয় টি-টুয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচের টার্গেটটা বাংলাদেশের আয়ত্বের মধ্যেই থাকবে। কিন্তু ব্যাটসম্যানদের কাজটা সহজই করে দেয়ার জন্য যে শুরুটা তাইজুল-মোস্তাফিজরা এনে দিয়েছিলেন সেটা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে না পারায় হিসেবটা পাল্টে গেল। ১৫ ওভার শেষে জিম্বাবুয়ের রান ছিল ৫ উইকেটে ৯৫। সেখান থেকে শেষ তিন ওভারে ৪৯ রান তুলে তারাই স্কোর বোর্ডে জমা করে ১৪৪।

বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে টস জিতে আগে বোলিং নেয়ার যুক্তি হিসেবে সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, আমাদের বোলিং বিভাগ বেশ শক্তিশালী, তাই শুরুতে উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ম্যাচের লাগামটাও টেনে ধরতে চান। জিম্বাবুয়ে ইনিংসের ১৫তম ওভার পর্যন্ত অন্তত বাংলাদেশ অধিনায়কের কথা খাপেখাপ মিলে যায়। কিন্তু তারপরই বিপত্তি। প্রথমে মাসাকাদজা এবং পরে রায়ান বুর্ল।

এক ওভারে ৩০ রান দিয়ে দেন সাকিব আল হাসান। তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে আর দেখা যায়নি এই চিত্র। পুরো ওভারের রানের পর্যায়ক্রম এমন ৬+৪+৪+৬+৪+৬!
এক ওভারে ৩০ রান দিয়ে দেন সাকিব আল হাসান। তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে আর দেখা যায়নি এই চিত্র। পুরো ওভারের রানের পর্যায়ক্রম এমন ৬+৪+৪+৬+৪+৬!

সাকিবের প্রথম ওভারে ৭ রান নিয়ে অবশ্য ইঙ্গিতটা অন্যরকম দিয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের দুই ওপেনার। কিন্তু অভিষেক টেস্টের মতো টি-টুয়েন্টির অভিষেকেও তাইজুল যে বাজিমাত করবেন সেটা হয়তো জানাই ছিল না তাদের। দ্বিতীয় ওভারের প্রথম এবং নিজের অভিষেক ম্যাচের প্রথম বলে উইকেট তুলে রেকর্ড গড়ে ফেলেন বাঁহাতি স্পিনার।

তাইজুলের সামান্য টেনে দেয়া বল উড়িয়ে মারতে গিয়ে মিসটাইমিং। সহজ ক্যাচ লুফে তাইজুলকে রেকর্ড বুকে নাম লেখাতে সাহায্য করেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। প্রস্তুতি ম্যাচে বিসিবি একাদশকে ভোগানো সফরকারীদের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান ব্রেন্ডন টেলর এদিন পৌছাতে পারেননি দুই অঙ্কেও (৬)।

তাইজুল ছুঁয়ে দেয়ার পর যেন জিম্বাবুয়ে ব্যাটিং অর্ডারের খুঁটি আর জোরই পেল না। প্রথম পাঁচ ব্যাটসম্যানের মধ্যে লড়লেন শুধু হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজ খেলতে নামা জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক ভালোই এগোচ্ছিলেন। কিন্তু সঙ্গীর অভাবে যতটা দরকার ততটা আগ্রাসী হতে পারেননি। ২৬ বলে পাঁচ চার ও এক ছক্কায় ৩৪ রান করতেই থামতে হয় তাকে। টপঅর্ডারে আর একজনই কেবল দুই ডিজিটের ঘরে যান, ক্রেইগ আরভিন (১১)।

তাইজুলের দেখানো পথে হেঁটে সফল হন মোস্তাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতও। আটোসাটো লাইনে বোলিং করে সাকিব ছাড়া প্রত্যেকেই ঝুলিতে ভরেন একটি করে উইকেট। সঙ্গে ফিল্ডারদের দুর্দান্ত ফিল্ডিং। সাব্বির রহমান যেমন চোখ ধাঁধানো ক্যাচ ধরেন, তেমনি সাকিব-মোস্তাফিজের যুগলবন্দিতে আসে রানআউটও।

এই অবস্থায় ১৬তম ওভারে বোলিংয়ে আসেন সাকিব। প্রথম বল থেকেই তার ওপর চড়াও হন সুর্ল। প্রতিটি বল বাউন্ডারি ছাড়া করে তুলে নেন ৩০টি রান। যার মধ্যে সমান তিনটি করে চার ছক্কার মার। সাকিবের এক ওভার পর মাঠে শুরু হয় বিদ্যুৎ বিভ্রাট। বেশ কিছুক্ষণ খেলা বন্ধ থাকার আবার শুরু হয়। বাকি শেষ ওভারে মোস্তাফিজ দেন ৮ রান। তাতে জিম্বাবুয়ের ফাইনাল স্কোর দাঁড়ায় ৫ উইকেটে ১৪৪।

জিম্বাবুয়ে দলের ব্যাটিং নায়ক রায়ান বুর্ল শেষ পর্যন্ত ৩২ বলে পাঁচ চার ও চার ছক্কায় অপরাজিত থাকেন ৫৭ রানে। তাকে সঙ্গ দেয়া টিনোটেনডা মুটোমবোজি ২৬ বলে করেন ২৭ রান। ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে ৮১ রান করে অবিচ্ছিন্ন থাকেন দুজন।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:
জিম্বাবুয়ে: ১৪৪/৫ (১৮ ওভারে, মাসাকাদজা ৩৪, বার্ল ৫৭*, মুতুমবদজি ২৭*, তাইজুল ১/২৬, সাইফুদ্দিন ১/২৬, মুস্তাফিজুর ১/৩১, মোসাদ্দেক ১/১০, সাকিব ০/৪৯)।
বাংলাদেশ: ১৪৮/৭ (১৭.৪ ওভারে, লিটন ১৯, সৌম্য ৪, সাকিব ১, মুশফিক ০, মাহমুদউল্লাহ ১৪, সাব্বির ১৫, মোসাদ্দেক ৩০*, আফিফ ৫২, সাইফুদ্দিন ৬*, জারভিস ২/৩১, মাদজিভা ২/২৫, চাতারা ২/৩২)।
ফল: বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ী।
ম্যাচসেরা: আফিফ হোসেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!