ডোন্টকেয়ার ডাক্তার, অস্পষ্ট প্রেসক্রিপশনে বিপাকে রোগী—ঔষধ বিক্রেতারা

হাইকোর্টের নির্দেশনার পরও প্রেসক্রিপশন নিয়ে ‘ডোন্টকেয়ার’ মনোভাব চট্টগ্রামের ডাক্তারদের। এখনো অস্পষ্ট হাতের লেখা। তাই প্রেসক্রিপশন নিয়ে রোগীদের দূর্ভোগ না কমে বরং বেড়েছে।

নগরীর বিভিন্ন ফার্মেসী দোকানদারদেরও বিস্তর অভিযোগ এই প্রেসক্রিপশন নিয়ে। আর এ জন্যই হরহামেশাই প্রেসক্রিপশন না বুঝে ভুল ওষুধ বিক্রি করায় রোগীদের তোপের মুখে পড়তে হয় ওষুধ বিক্রেতাদের। তাই তারা আবার এটিও বলছেন, এর দায় যতটা ফার্মেসির লোকদের তারচেয়ে বড় দায় চিকিৎসকের।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রেসক্রিপশনে চিকিৎসকদের হাতের লেখার কারণে ভুল ওষুধ সেবন করছেন অনেক মানুষ।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার অভিযোগ গেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে।

চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) স্পষ্টভাবে বা বড় অক্ষরে বা ছাপানো আকারে দিতে চিকিৎসকদের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে সার্কুলার জারির নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। ২০১৭ সালের ৯ জানুয়ারি স্বাস্থ্যসচিব এবং বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রারের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

একই দিন একটি রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।

এর আগে ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভুল ওষুধ বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে ২ জানুয়ারি মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে দুই আইনজীবী রিট করেন।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোখলেছুর রহমান। শুনানি শেষে আদালত রুল দেন।

এতে রোগীদের জন্য স্পষ্টভাবে ব্যবস্থাপত্র লেখায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং ব্যবস্থাপত্র জেনেরিক নাম লেখার কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়।

স্বাস্থ্যসচিব, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সেক্রেটারিসহ বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল।

এছাড়াও সার্কুলার জারির নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি ছয় সপ্তাহের মধ্যে স্বাস্থ্যসচিব এবং বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রারকে জানাতে বলা হয়। পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেন।

তারপরও আগের মতোই প্রেসক্রিপশনের ধারা বজায় রেখেছেন ডাক্তাররা।

নগরীর কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল, ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বারে রোগীদের হাতে আগের মতোই দুর্বোধ্য ও অস্পষ্ট হাতের লেখার প্রেসক্রিপশন নিয়ে ঘুরতে দেখা গেছে।

প্রফেসর ডা. ঝুলন দাশ শর্মা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান। বর্তমানে চেম্বার করেন কে বি ফজলূর কাদের রোডের বেসিক ল্যাবে। রোগীকে দেওয়া তার প্রেসক্রিপশনে হাতের লেখা অস্পষ্ট। মেডিকেলের পূর্ব গেটের কয়েকজন ফার্মেসী দোকানদার জানান, ঝুলন শর্মার হাতের লেখা প্রেসক্রিপশন বুঝতে আমাদের সমস্যা হয়।

এ বিষয়ে জানতে ডা. ঝুলন শর্মার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ফার্মেসী দোকানদার ও রোগীর অভিভাবক আমার প্রেসক্রিপশন বুঝতে পারেন না, এ অভিযোগটি তার নতুন শোনা। তবে অনেক সময় একই ওষুধের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর আলাদা আলাদা নাম থাকে। এত নাম লেখা তাদের কাছে বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায বলে জানান এই শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা রোগীদের যেসব ওষুধ নির্দেশিকা দেওয়া হয় তার লেখা দুর্বোধ্য হয়ে দাঁড়ায় রোগী ও ফার্মেসী মালিকদের। পোস্তারপাড় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একাধিক প্রেসক্রিপশন সংগ্রহ করা আছে এ প্রতিবেদকের। যে প্রেসক্রিপশন থেকে ওষুধের নাম পড়া কষ্টকর।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে বিভিন্ন কোম্পানীর সব মিলিয়ে প্রায় ২৭ হাজার ওষুধ রয়েছে। এই সবকটি ওষুধেরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বাণিজ্যিক নাম। তবে ডাক্তারদের কারও কারও অভিমত, এত এত ওষুধের নাম ও বিচিত্র বানানের সঙ্গে প্যাঁচানো দুর্বোধ্য লেখার একটা যোগসূত্রও রয়েছে।

জটিল এ সমস্যা থেকে উত্তরণে ওষুধ কোম্পানিগুলোরও একটা বড় ভূমিকার কথা এবার আদালতও কিছুটা বলে দিয়েছে।

হাইকোর্টের রায়ে স্পষ্টভাবে প্রেসক্রিপশন লেখার পাশাপাশি ওষুধের ব্র্যান্ড বা বাণিজ্যিক নামের পরিবর্তে জেনেরিক নাম লেখার কথাও বলা হয়েছে। কেন প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক নাম লেখা হবে না এই মর্মে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শাতে বলেছে।

এদিকে হাইকোর্টের এ নির্দেশানর পরও জনগুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি মনিটরিংয়েরও তেমন ব্যবস্থা নেই। ফলে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে জনস্বাস্থ্য।

চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি, জামালখান, ওআর নিজাম রোড, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনেসহ ডাক্তারপাড়ায় একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা হয় চট্টগ্রাম প্রতিদিনের।

তারা জানান, কিছু ডাক্তারের লেখা এমনই খারাপ যে, প্রেসক্রিপশন নিয়ে একটার পর একটা ওষুধের দোকানে ঘুরতে হয়। কেউ-ই তা বোঝেন না।

কিছু রোগী ও তাদের স্বজনরা অভিযোগ করেন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে লাইন ধরে টিকেট কিনে আবারও লাইন ধরে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। পরে ওষুধ কিনতে গিয়ে প্রেসক্রিপশনে ডাক্তারের লেখা নিয়ে পড়তে হয় নতুন ঝামেলায়। কিছু প্রেসক্রিপশনের লেখা সংশোধন করতে গিয়েও পড়তে হয় নানা সমস্যায়।

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘চিকিৎসকরা বিভিন্ন উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাই তাদের হাতের লেখা খারাপ- এমন কিন্তু নয়। তারা ইচ্ছা করলেই রোগীদের স্বার্থে প্রেসক্রিপশনের লেখা স্পষ্ট করতে পারেন। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের নির্দেশনা দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আর নিতান্তই যাদের হাতের লেখা খারাপ তারা কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে প্রেসক্রিপশন লিখবেন।’

সিভিল সার্জন আরও জানান, হাইকোর্টের রায়ের পর মন্ত্রনালয় থেকে সার্কুলার জারি হয়। পরে প্রজ্ঞাপনটি হাতে আসার পর তা চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সতর্কও করে দেওয়া হয়েছে ডাক্তারদের। কিন্তু প্রেসক্রিপশনে অস্পষ্ট হাতের লেখার অপরাধে আজ অবধি কোন ডাক্তারের শাস্তি হয়নি। আর এ জন্যই কোন ভালো ফল আসেনি বলে জানান এই স্বাস্থ্যকর্মকর্তা।

অবশ্য এ প্রসঙ্গে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় বলেন, ‘আদালত রুল জারি করলেই ডাক্তারের হাতের লেখা হঠাৎ করে ভালো হয়ে যাবে এমনটা ভাবা অমূলক। এক্ষেত্রে নৈতিকতা ও বিবেকবোধকে কাজে লাগাতে হবে। প্রতিদিন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারকে বহির্বিভাগের তিন শতাধিক রোগী দেখতে হয়। সকাল থেকেই রোগীদের চাপ থাকে। রোগীরা বিরক্ত হয়ে যায়। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডাক্তারদের তাড়াহুড়ো করতে হয়।’

এক্ষেত্রে কম্পিউটারের মাধ্যমে করা যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘করতে পারলে ভালো হয়।’

নগরীর জামালখান বেলভিউ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নীচে অপেক্ষমান বিক্রয় প্রতিনিধি মোখলেসুর রহমান জানান, অনেক চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে হাতের লেখা দুর্বোধ্য হওয়ায় ওষুধের নাম বুঝতে সমস্যা হয়। অনেক চিকিৎসকের হাতের লেখায় অনেক সময় ইংরেজি ‘ইউ’কে ‘ডব্লিউ’, ‘ই’ কে ‘এ’, ‘এল’ কে ‘আই’ মনে হয়। এতে সমস্যা হয়। তখন রোগী বা স্বজনদের কাছ থেকে রোগ সম্পর্কে জেনে ওষুধের নামের ধারণা করা হয়। এতে ফার্মেসীতে ভুল হওয়ার সম্ভবানা বেড়ে গিয়ে রোগীর হাতে ভুল ওষুধ চলে যায়।

তিনি আরও জানান, চিকিৎসকের হাতে লেখা ব্যবস্থাপত্র ইংরেজি বড় অক্ষরে লিখলে পড়তে এবং বুঝতে সুবিধা হয়। তবে কম্পিউটারে টাইপ করা প্রেসক্রিপশন হলে সবচেয়ে ভালো হয়।

তবে এর ভালো প্রাকটিসও শুরু করেছেন অনেক চিকিৎসক। গ্যাস্ট্রোলজি চিকিৎসক বিনয় কুমার পাল তার রোগীদের কম্পিউটারে কম্পোজ প্রেসক্রিপশন দেন।

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত ওষুধের দোকানের সংখ্যা ১ লাখ ২৩ হাজার। এ ছাড়াও প্রায় ১০ হাজার অনিবন্ধিত ওষুধের দোকান রয়েছে। বেশির ভাগ দোকানেই ওষুধ সম্পর্কে জানাশোনা লোক না থাকায় ব্যবস্থাপত্র নিয়ে রোগীরা সমস্যায় পড়েন। এমনকি কখনও ভুল ওষুধের বিড়ম্বনায় পড়েন।

তবে চট্টগ্রামে চেয়ে ঢাকার রাজধানীর ইউনাইটেড, অ্যাপোলো, স্কয়ার, বারডেম, মডার্ন, ল্যাবএইডসহ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক রোগীদের কম্পিউটারে টাইপ করা ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। ওষুধ সেবনের নিয়মাবলীও স্পষ্টভাবে টাইপ করে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা হয়।

এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!