ডিজিটাল জরিপের নামে ডিজিটাল চাঁদাবাজি মিরসরাইয়ে

ভুক্তভোগীদের সংবাদ সম্মেল

সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামের তিনটি উপজেলায় ডিজিটাল ভূমি জরিপের কাজ শুরু করেছে সরকার। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ থানার করেরহাট ইউনিয়নে ‘আরএস টু’ নামের এ জরিপ কাজ চলছে। তবে জরিপ কাজে নিয়োজিত সরকারি সার্ভেয়ার ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জমির মালিকানা, শ্রেণি ও সীমানা পরিবর্তনের কথা বলে ঘুষ লেনদেনসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।

শুক্রবার (২৮ জুন) সকাল ১০টায় করেরহাট ইউনিয়নের উদয়ন ক্লাব মিলনায়তনে এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে ভুক্তভোগী জমির মালিকরা। তারা ডিজিটাল জরিপের নামে ডিজিটাল চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কয়েকশ জমির মালিক, এলাকার জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।

সংবাদ সম্মেলনে জমি মালিকদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, স্থানীয় জমি মালিক মুক্তিযোদ্ধা তোবারক হোসেন। জরিপ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রেক্ষিতে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন স্থানীয় করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন ও করেরহাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মো. সেলিম।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে মিরসরাই উপজেলা সেটেলম্যান্ট অফিস করেরহাট ইউনিয়নের কাটাগাং, ভালুকিয়া, জয়পুর, পূর্বজোয়ার ও পশ্চিম জোয়ার মৌজা এলাকায় ডিজিটাল সার্ভের কাজ শুরু করে। অভিযোগ করা হয়, সার্ভে টিমের লোকজন স্থানীয় জমি মালিকদের সঙ্গে কোনরকম সমন্বয় না করে একতরফাভাবে নকশা প্রণয়ণ করছেন। এছাড়া জমির নকশা ঠিকঠাকভাবে করে দিবে এ বলে বেশ কিছু জমি মালিক থেকে টাকা দাবি করেছে। নিরুপায় হয়ে অনেকেই তাদের টাকাও দিয়েছেন।

ভুক্তভোগী জমি মালিকরা জানান, এখানে ডিজিটাল জরিপ করার সময় জমি মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ না করায় জরিপ ত্রুটিযুক্ত হচ্ছে। জরিপ টিমে নিয়োজিত লোকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা বারবার বলছে ৩০ এবং ৩১ এর একটি ধারায় ত্রুটিযুক্ত জরিপ সংশোধন করা সম্ভব। অথচ দেশের বিএস জরিপে ত্রুটি থাকার দরুণ দেশের লক্ষ লক্ষ পরিবার আদালতে যেতে যেতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। আবারও যদি একই ত্রুটি বিচ্যুতি থাকে তাহলে নতুন এ জরিপ জনগণের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদী কলহ ও সংঘাতের জন্ম দিবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ইউনিয়নের জয়পুর পূর্বজোয়ার গ্রামের মোহাম্মদ তাহের আহম্মদ ২০১৬ সালের চার ডিসেম্বর একই ইউনিয়নের পশ্চিম জোয়ার গ্রামের ফোরখ আহামদ মিস্ত্রী থেকে রেজিস্ট্রিযুক্ত দলিলের মাধ্যমে ১৮ শতক জমি ক্রয় করেন। বরৈয়া মৌজার বিএস ৩৬৮ দাগের ওই জমি দলিলমূলে তিনি সৃজিত খতিয়ানেও (নম্বর ৫৩৭) অন্তর্ভুক্ত করেন। অথচ ডিজিটাল সার্ভে টিম তার ক্রয়কৃত জমি পূর্বের মালিক ফোরখ আহামদের নামে (ডিপি খতিয়ান নং ৬৬৮) অন্তর্ভুক্ত করে।
মোহাম্মদ তাহের আহম্মদ অভিযোগ করেন, জরিপ কাজে নিয়োজিত লোকজন তার ক্রয়কৃত জমি খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করতে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ চায়। দাবিকৃত ওই টাকা না দেওয়ার কারণে পূর্বের মালিকের (যিনি বর্তমানে মৃত) নাম খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ডিজিটাল জরিপের নামে ডিজিটাল চাঁদাবাজি মিরসরাইয়ে 1

পশ্চিম জোয়ার গ্রামের জমি মালিক কবির আহাম্মদ অভিযোগ করেন, ডিজিটাল সার্ভে টিমের সঙ্গে থাকা করেরহাট ইউনিয়ন সার্ভেয়ার আবুল কাশেম তার কাছ থেকে তিন হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন। বিনিময়ে জমির খতিয়ান, সীমানা ও শ্রেণি পূর্বের জায়গায় বলবৎ রাখবেন বলে কথা দিয়েছেন।

ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে বক্তব্য নিতে সার্ভেয়ার আবুল কাশেমকে ফোন দিলে তিনি মতামত জানাতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, আপনি এসব বিষয়ে আমার বড় সাহেবের (উপজেলা সেটেলম্যান্ট কর্মকর্তা) সঙ্গে কথা বলেন।

স্থানীয় চত্তরুয়া গ্রামের মো. সাঈদুজ্জামান অভিযোগ করেন, ভালুকিয়া মৌজায় তার কিছু জমি রয়েছে। সেখানে জরিপ চলাকালীন সময়ে সার্ভেয়ার জাকির হোসেনের কাছে তিনি কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাকির হোসেন তাকে তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন নয়ন জানান, জরিপ দলের সঙ্গে যারা কাজ করছেন তারা জমি মালিকদের সঙ্গে কোনো ধরণের সমন্বয়ন করছেন না, ফলে জনগণের মধ্যে এক ধরণের অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এছাড়া চেয়ারম্যান অভিযোগ করেন, ‘আমার নিজের বাড়ির সড়কটিও অন্যের নামে জরিপ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া আমার এলাকার সাধারণ মানুষ থেকে জরিপ কাজে অংশ নেওয়া লোকজন ঘুষ হিসেবে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

ভুক্তভোগী জমির মালিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির অভিযোগ প্রসঙ্গে মিরসরাই সেটেলম্যান্ট অফিসের সহকারী সেটেলম্যান্ট অফিসার আবুল কাশেম বলেন, ‘আমরা সরেজমিনে গিয়ে জরিপ কাজ করছি। এর মধ্যে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি থাকতে পারে। তবে শীঘ্রই আমরা সমন্বয়ের মাধ্যমে সঠিকভাবে জরিপ কাজ চালাতে সক্ষম হব বলে আশা করছি।’
সার্ভেয়ারদের ঘুষলেনদেন প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাকে যদি এসকল বিষয়ে অভিযোগ দেওয়া হয় তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল আমিন বলেন, ‘এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ এলাকার লোকজন আমাকে দিয়েছেন। যেহেতু এলাকার লোকজনের মধ্যে এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে আপাদত জরিপ কাজ বন্ধ থাকবে। এছাড়া একজনের জমি অন্যজনের নামে করে দেওয়ার মতো গুরতর অভিযোগ রয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এএইচ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!