ডা. শাহ আলম হত্যাকাণ্ড: সেফ লাইনকে ঘিরেই সন্দেহ

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ডা. শাহ আলম হত্যাকাণ্ডের পর আবারো আলোচনায় এসেছে সেই ‘সেফ লাইন পরিবহন’। মহাসড়কে তিন চাকার গাড়ি নিষিদ্ধ করার পর চার চাকার ফিটনেসবিহীন গাড়ি বৃদ্ধি পায়। তাদের একটি লাইনের নাম ‘সেফ লাইন’। মিরসরাই থেকে সীতাকুণ্ড একটি রুট, সীতাকুণ্ড থেকে সিটি গেট পর্যন্ত আরেকটি রুট। তবে মাঝে মাঝে অলংকার মোড় পর্যন্ত চলাচল করতেও দেখা যায় গাড়িগুলোকে । অভিযোগ উঠেছে, অদক্ষ চালক ও হেলপারের কারণে দুর্ঘটনা ছাড়াও, সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী বা ডাকাতদের হাতে প্রাণহানির ঘটনা নিয়মিত ঘটে সেফ লাইনে।

বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৯টায় সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরা বাইপাস থেকে মো. ইজাব তার মামা ডা. শাহ আলমকে সেফ লাইনের গাড়িতে তুলে দেন। ইজাব ভেবেছিলেন অন্যদিনের মতো তার মামা চান্দগাঁওয়ের বাসায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু বাসায় না পৌঁছায় স্ত্রী-সন্তানরা ধরে নিয়েছিলেন ডা. শাহ আলম সীতাকুণ্ডে অবস্থান করছেন।
তবে ডা. শাহ আলম সীতাকুণ্ডেই ছিলেন। তবে জীবিত নয়, মৃত শাহ আলমের লাশ পড়েছিল সীতাকুণ্ড ঘাটঘর এলাকায়। শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) সকালে স্থানীয়দের দেওয়া সংবাদে সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।
ডা. শাহ আলমের ভাগিনা মো. ইজাব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, আমার ছোট মামা ডা. শাহ আলমকে আমি রাত সাড়ে ৯টার দিকে ছোট কুমিরা বাইপাস থেকে সেফ লাইনে তুলে দিয়েছিলাম। তখন গাড়িতে চালক, হেলপার আর একজন মাত্র যাত্রী ছিলেন।

জানা গেছে, শুক্রবার রাতে লাশ সনাক্ত হওয়ার পর শনিবার ময়নাতদন্ত শেষে স্ত্রী-সন্তানরা লাশ গ্রহণ করেন। আসর নামাজের পর নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক মসজিদে নামাজে জানাযা শেষে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।
নিহত ডা. শাহ আলম সীতাকুণ্ড কুমিরা ইউনিয়নের ছোট কুমিরার মরহুম মাস্টার আজিজুল হকের ছেলে। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) থেকে এমবিবিএস শেষ করে চমেকের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল গনি শিকদারের মেয়ে অমরানা আজমিরি শিকদার কান্তার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কান্তা নগরীর মরহুম আবু শাহিদ দোভাসের মেয়ের ঘরের নাতনি। শাহ আলম-কান্তার সংসারে দুই পুত্রসন্তান রয়েছে। একজন বিবিএ প্রথম বর্ষে পড়ছেন, অপরজন দশম শ্রেণীতে। ডা. শাহ আলম দীর্ঘ ৩০ বছর সৌদি আরবের একটি স্বনামধন্য হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি সীতাকুণ্ডে নিজ গ্রামে শিশুদের জন্য ‘চাইল্ড কেয়ার’ নামে মানসম্পন্ন একটি ক্লিনিক চালু করেন।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সেফ লাইন সার্ভিসে প্রতিমাসে গড়ে অর্ধ শতাধিক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে বলে এলাকার লোকজন অভিযোগ করেছেন। ছিনতাই-দুর্ঘটনায় প্রাণহানির কারণে সেফ লাইন ওই এলাকার মানুষের কাছে একটি আতঙ্কের নাম। ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, হেলপার দিয়ে পরিচালিত এই পরিবহনে আর আস্থা রাখতে পরছেনা যাত্রীরা। গত বছর কলেজ অধ্যক্ষ আমিনুর রসুল এবং শিক্ষার্থী জারিফার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র মহাসড়কে বিশাল মানবপ্রাচীর তৈরি করে এলাকাবাসী প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত অর্ধ শতাধিক যাত্রী নিহত হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ দুর্ঘটনায়, আবার কেউ কেউ রাতের আঁধারে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী কিংবা ডাকাতের কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। মহাসড়কের সীতাকুণ্ড-মিরসরাইয়ে যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগই ঘটেছে সেফ লাইন সার্ভিসে।
চট্টগ্রাম জেলা হিউম্যান হলার মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, ডা. শাহ আলম এলাকায় একজন সম্মানিত ও ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাকে অনেকেই চিনতেন, জানতেন। রাত ৮টার পর আমাদের লাইন বন্ধ থাকে। কেউ যদি চালায় তার দায়িত্ব আমরা নিতে পারব না। আবার লাইন বন্ধ হয়ে গেলে অন্য লাইনের গাড়িও এই লাইনে যাত্রী পরিবহন করে। এটা তাদের কাজও হতে পারে। প্রশাসন আমাদের কাছে সহযোগিতা চাইলে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।
চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, সীতাকুণ্ড থেকে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত লাশটির পরিচয় সনাক্ত হয়েছে। লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। লাশ আমরা পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি। খুনের প্রাথমিক তথ্য ও আলামত আমরা সংগ্রহ করেছি। রহস্য উদঘাটনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সার্কেল পুলিশ সুপার ও জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ একযোগে কাজ করছে। শিগগিরই রহস্য উদঘাটন হবে।

সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শামীম শেখ শনিবার (১৯ অক্টোবর) রাত ১০টায় জানান, নিহত ডা. শাহ আলমের স্ত্রী অমরানা আজমিরি শিকদার বাদি হয়ে সীতাকুণ্ড থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তদন্ত চলছে। শিগগিরই হত্যার রহস্য উন্মোচন হবে বলে তিনি জানান।

সিআর

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!