ডাক্তার পেয়ে ‘ক্ষমতার জোর’ দেখালেন সাতকানিয়ার ইউএনও, অশোভন আচরণ

ডাক্তারের বিরুদ্ধেই রোগ সংক্রমণ আইনে মামলা

করোনায় অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার চেম্বার বন্ধ করে দেওয়ায় রোগীরা যখন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, এমন এক অবস্থায় চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় রোগী দেখে যাওয়ার সময় এক ডাক্তারকে জরিমানা করলেন সাতকানিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নজরুল ইসলাম। শুধু তাই নয়, ওই ডাক্তারের সঙ্গে অত্যন্ত অশোভন আচরণের অভিযোগও উঠেছে ইউএনওর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ইউএনওর শাস্তি দাবি করেছেন চট্টগ্রামের চিকিৎসক নেতারা।

জরিমানার শিকার হওয়া ডাক্তারের নাম ফরহাদ কবির। গত ২ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায় রোগী দেখার জন্য মোটর সাইকেলযোগে সাতকানিয়া পৌর এলাকায় চেম্বারে যাওয়ার সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম তাকে এক হাজার টাকা জরিমানা করেন।

জরিমানার শিকার হওয়া সাতকানিয়ার পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ডের সোনাকানিয়া ছড়ারকুলের বাসিন্দা ডা. ফরহাদ কবির ঘটনার বিবরণ দিয়ে জানান, ‘আমি পৌরসভার নাছির ফার্মেসি ও মক্কা ফার্মেসিতে নিয়মিত চেম্বার করি। ঘটনার দিন আমি চেম্বার শেষ করে ফিরছিলাম। ওই সময় একজন ইমার্জেন্সি রোগী আসার বিষয়ে ফোন পেয়ে মাঝপথ থেকে আবার চেম্বারে যাচ্ছিলাম। তখন সাতকানিয়া পৌরসভার কলেজ রোডের মুখে ইউএনও সাহেবের সাথে দেখা হয়। এসময় ইউএনও’র সাথে থাকা লোকজন সিগন্যাল দিলে আমি মোটরসাইকেল থামিয়ে আমার পরিচয় দিই।’

ডা. ফরহাদ কবির বলেন, ‘ডাক্তার পরিচয় পাওয়ার পর ইউএনও কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে যা ইচ্ছা তাই বললেন। এরপর ইউএনওর সাথে থাকা এক লোক আমার কাছ থেকে মোটরসাইকেলের চাবিটি নিয়ে ফেলে। একপর্যায়ে ইউএনও জানান, আমাকে দুই হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, লকডাউনে বের হয়েছেন এজন্য। তখন আমি উনাকে ডাক্তারদের চেম্বারে যাওয়া আসায় বিধি নিষেধ না থাকার বিষয়ে বলি। এতে আরো বেশি রেগে যান ইউএনও। তিনি বলেন, আমি চাইলে আপনাকে জেল দিতে পারি। তা করলাম না, এক হাজার টাকা জরিমানা দেন।’

ডা. ফরহাদ কবির আরও বলেন, ‘অনেক লোকের সামনে তিনি ডাক্তারদের সম্পর্কে অনেক কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। এক পর্যায়ে মামলা লিখে আমার হাতে দিয়ে এক হাজার টাকা দিতে বলেন। তখন আমি টাকা দিয়ে দিই। এরপর ইউএনওর সাথে থাকা লোকদের বলেন, ছবি উঠান, ডাক্তারকে যে জরিমানা করছি এটা পত্রিকায় দিতে হবে। পরে অনেকে মুঠোফোনে আমার ছবি তুলেছেন। জীবনে আমি কোনদিন এ ধরনের অপমান বোধ করিনি। আমি বুঝতে পারছি না একজন ইউএনও কিভাবে এমন খারাপ আচারণ করতে পারেন?’

এদিকে ঘটনার বিষয়ে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘উনি যে ডাক্তার সেটা তো আমি বুঝতে পারিনি। উনার সাথে আইডি কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং হেলমেট ছিল না। তিনি যে অন্যায় করেছেন সেটা নিজে বুঝতে পেরেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, আমার অন্যায় হয়েছে। আমাকে শাস্তি দেন। পরে আমি এক হাজার টাকা জরিমানা করেছি। আইন সবার জন্য সমান। সরকার আইন করেছে আমরা বাস্তবায়ন করছি। তিনি চাইলে আপিল করতে পারেন। মূলত সন্ধ্যা ৭ টার পর পাওয়াতে, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও হেলমেট না থাকায় জরিমানা করা হয়েছে।’

ইউএনও ডাক্তারের সাথে পরিচয়পত্র না থাকার কথা বললেও মামলায় ডাক্তার ফরহাদ কবির লেখা হয়েছে। মোটরযান আইনে মামলা দেওয়ার কথা বললেও মামলায় অপরাধ হিসেবে দন্ডবিধি ২৭০ ও ২৭১ উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ধারায় বিদ্বেষপূর্ণ কর্ম, যা দ্বারা জীবন বিপন্নকারী রোগের সংক্রমণ বিস্তার লাভের সম্ভাবনা রয়েছে এবং সঙ্গরোধ সংক্রান্ত নিয়ম অমান্য করার কথা উল্লেখ রয়েছে।

এ বিষয়ে বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির জানান, ‘বিষয়টি আমি শুনেছি। ভুক্তভোগী ডাক্তার আমাকে জানাননি। স্বাচিপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে আমি বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলেছি। উনারা বলেছেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। চলমান লকডাউনে ডাক্তারদের চলাচলের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রশ্নই উঠে না।’

ঘটনার বিষয়ে স্বাচিপ’র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান জানান, ‘লকডাউনে ডাক্তারদের চলাচলে সরকারিভাবে কোন ধরনের বাধা নাই। এরপরও একজন ডাক্তার রোগী দেখার জন্য চেম্বারে যাওয়ার সময় ইউএনওর এমন আচরণ অত্যন্ত দুঃখজনক। চিকিৎসকরা করোনা মহামারীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ইউএনওর এমন আচরণ চিকিৎসকদের হতাশ করে ফেলবে।’

ডা. মিনহাজ বলেন, ‘ডা. ফরহাদ কবির কি এমন কোন কাজ করেছেন যা জীবন বিপন্নকারী মারাত্মক কোন রোগের (বা চলমান কোভিড) সংক্রমণ ছড়াতে পারে এবং এই অপরাধে তাকে ২৭০ ও ২৭১ ধারায় অভিযুক্ত করে জরিমানা দেয়া হলো! উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, এই চিকিৎসকের হেলমেট ছিলো না। তাহলে তাকে মোটরযান আইনে জরিমানা বা শাস্তি প্রদান না করে দন্ডবিধির ২৭০ ও ২৭১ ধারায় কেনো অভিযুক্ত করা হলো?

ডা. মিনহাজ বলেন, ‘এই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চিকিৎসক সম্পর্কে নানা অযাচিত মন্তব্য করে ডা. ফরহাদ কবিরকে দয়া করে জেলে পাঠানোর পরিবর্তে এক হাজার টাকা জরিমানা করার স্বগতোক্তিও করেছেন!’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!