ডাক্তার নয়, চট্টগ্রাম মেডিকেলে ওয়ার্ডবয়ের হাতে ‘হাড়ভাঙ্গা’র সার্জারি, স্লিপ লিখেই খালাস ডাক্তাররা

‘মিনি ওটি’তে চলে সব ‘অপারেশন’, নিয়ন্ত্রণে ওয়ার্ডবয় রবিউল

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৬ নম্বর অর্থোপেডিকস ওয়ার্ড। ওয়ার্ডটি ‘হাড়ভাঙ্গা ওয়ার্ড’ নামে পরিচিত। সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা অন্য দুর্ঘটনায় হাড়ভাঙ্গা রোগীদের চিকিৎসার জন্য এ ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। কিন্তু এ ওয়ার্ডে গেলে দেখা যাবে পুরো ওয়ার্ডজুড়ে ওয়ার্ড বয়দের ছুটোছুটি। ডাক্তার ও নার্সরা তাদের নিজস্ব রুমে বসে বেশিরভাগ সময় অলস সময় কাটান বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক সময় এদের অনেকে দায়িত্বেই থাকেন অনুপস্থিত। এই সুযোগে ওয়ার্ডের ভেতরেই ‘মিনি অপারেশন থিয়েটার’ বানিয়ে প্রকাশ্যেই সব ধরনের সার্জারি করে থাকেন ওয়ার্ডবয়রা।

রোগীর সার্জারি কাজে ব্যবহৃত ইট, রড, গজ, ব্যান্ডেজ সব কিনতে হয় রোগীর টাকাতেই। আর ওয়ার্ডজুড়ে গিজগিজ করা দর্শনার্থী থাকার সুযোগ করে দিয়ে ওয়ার্ডবয়রা রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে নিচ্ছেন বাড়তি টাকা। চিকিৎসকরা রোগীকে দেখে পরীক্ষা নিরীক্ষা কোন্ ল্যাবে করবেন তার একটা স্লিপ ধরিয়ে দেন। কাজের কাজ বলতে গেলে এটাই করতে দেখা গেছে চিকিৎসকদের।

সারা বছরই চট্টগ্রাম মেডিকেলের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের চিত্র এরকমই। এ ওয়ার্ডের চিকিৎসাধীন রোগী ও স্বজনদের অনেকেই ক্ষোভের সাথে এ প্রতিবেদককে জানান, ওয়ার্ডবয়দের হাতে জিম্মি তারা। বড় অভিযোগ এটাও— কাটাছেঁড়া, ড্রেসিংয়ের কাজে গুণতে হয় রোগীদের নগদ টাকা। আর ওয়ার্ডবয়রা রোগীর কাছ থেকে চাহিদামতো টাকা আদায় করতে না পারলে খুব খারাপ আচরণ করেন।

জানা গেছে, রোববার (৩১ জানুয়ারি) পর্যন্ত ২৬ নম্বর অর্থোপেডিকস ওয়ার্ডে ৮৮টি সিটের বিপরীতে রোগী ভর্তি আছে ২৪৪ জন। কোনো কোনোদিন এই সংখ্যা ২৬০ থেকে ২৭০ জনও ছাড়িয়ে যায়।

রোববার বেলা আড়াইটায় ওয়ার্ডের পশ্চিম পাশে এক রোগীর চিৎকার শোনা যাচ্ছিল অনেক দূর থেকেই। সড়ক দুর্ঘটনায় পা ভেঙে এ ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন রোগী তমিজ উদ্দিন। বাড়ি তার ফেনীতে। তাকে ঘিরে ধরে রেখেছে ৪ থেকে ৫ জন। ওয়ার্ডবয় রবিউল ও আব্দুর রউফ রোগীর পায়ে কাটা ছেঁড়ার জায়গাটি ড্রেসিং করছেন রোগীর সিটের সামনে দাঁড়িয়েই। পাশের আরেক সিটে কাপড় দিয়ে ঘিরে আরেক রোগীর সার্জারি সারছেন ওয়ার্ড বয় রায়হান ও তার সাথে থাকা ৪ থেকে ৫ ওয়ার্ড বয়।

ডাক্তার নয়, চট্টগ্রাম মেডিকেলে ওয়ার্ডবয়ের হাতে ‘হাড়ভাঙ্গা’র সার্জারি, স্লিপ লিখেই খালাস ডাক্তাররা 1

জানা গেছে, ২৬ নম্বর অর্থোপেডিকস সার্জারি ওয়ার্ডে সার্জারির কাজ করে থাকেন ২০ থেকে ২৫ জন ওয়ার্ডবয়। ওয়ার্ডে সহকারী রেজিস্ট্রার, ইনডোর মেডিকেল অফিসার, এমডি শিক্ষার্থী, ইন্টার্ন চিকিৎসকসহ কর্মরত আছেন ২৫ জন চিকিৎসক। প্রতি শিফটে তাদের দায়িত্ব পালনের নিয়ম থাকলেও বেশিরভাগ সময়েই সেই দায়িত্বে কেউ থাকেন না— এমন অভিযোগ মিলেছে রোগীদের কাছ থেকে।

২৬ নম্বর অর্থোপেডিকস সার্জারি ওয়ার্ডের সামনে রয়েছে মিনি ওটি বা অপারেশন থিয়েটার। সেখানে দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের নিয়ে গিয়ে সার্জারি করার নিয়ম কর্মরত চিকিৎসকদের। কিন্তু সেখানে সার্জারির কাজ করেন ওয়ার্ড সর্দার আব্দুর রউফ, সুইপার তপন দাশসহ আরো জনাদশেক এলএমএস পদবির কর্মচারী। সাথে রয়েছেন ওয়ার্ডবয়। এ ওয়ার্ডবয়দের মধ্যে ৫ থেকে ৭ জন হাসপাতাল থেকে সংযুক্ত হলেও বাকিদের সবাই চুক্তিভিত্তিক। এদেরই একজন রবিউল। পুরো ওয়ার্ডজুড়ে তার হাঁকডাকে সন্ত্রস্ত অবস্থা। রোগী কথা না শুনলে গায়ে হাত তোলাসহ সার্জারির জায়গায় ড্রেসিং করতে এসে প্লাস্টারের স্থানে ক্ষত তৈরি করে দেন বলে অভিযোগ করলেন একাধিক রোগী ও তাদের স্বজনরা।

এদিকে ওয়ার্ডের বাইরে মিনি ওটি রুমে রোগীদের প্লাস্টার ও সার্জারী নিয়ে যখন ওয়ার্ডবয়রা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন, তখন ওয়ার্ডের ভেতরে বসে থাকতে গেল দেখা গেল তিন চিকিৎসককে। এদের একজন ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্ট্রার আব্দুর রউফ ফয়সাল। চিকিৎসক ও নার্স বাদ দিয়ে ওয়ার্ডবয় কেন সার্জারির কাজ করছেন— সে বিষয়ে জানতে চাইলে এ চিকিৎসক উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং প্রতিবেদককে কিছু বলতে বাধ্য নন বলে জানিয়ে দেন। তিনি কোনো কিছু জানার দরকার হলে হাসপাতালের পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।

ডাক্তার নয়, চট্টগ্রাম মেডিকেলে ওয়ার্ডবয়ের হাতে ‘হাড়ভাঙ্গা’র সার্জারি, স্লিপ লিখেই খালাস ডাক্তাররা 2

তবে সহকারী রেজিস্ট্রার আব্দুর রউফ ফয়সাল অবশ্য এটিও বলেন, ‘আমাদের কাজ রোগীকে দেখে তারা কোন্ ল্যাবে কী কী ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা করবে, তা বলে দেওয়া। আর এটি করতে গিয়েই আমরা হয়রান হয়ে পড়ি।’

এদিকে ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীদের কাছ থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে শোনা গেল বিস্তর অভিযোগ। নগরীর অলংকার মোড় থেকে এ ওয়ার্ডে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হওয়া এক রোগী ম্যাক্সিমা গাড়ি চালাতেন। গত মাসে এক দুর্ঘটনায় তিনি ডান পায়ে আঘাত পান— তার পায়ের হাড় ভেঙ্গে গেছে। এ পর্যন্তু ১৭ দিনে এ ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিতে গিয়ে গিয়ে তার খরচ হয়েছে ২২ হাজার টাকা। ওষুধ, গজ, ব্যান্ডেজ, রড, পরীক্ষা-নিরীক্ষা— সবই করতে হয়েছে নিজের টাকায়। প্রতিবার ব্যান্ডেজ ড্রেসিংয়ের জন্য ওয়ার্ডবয়কে দিতে হয়েছে ৫০০ টাকা। ওয়ার্ডেবয়ের সাথে থাকা আয়াকে দিতে হয়েছে ২০০ টাকা। প্রতি পদে পদে টাকা দিতে গিয়ে ওই রোগী আর চিকিৎসা খরচ চালাতে পারছেন না বলে জানান।

২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ঘন্টাদুয়েক অবস্থান করে যা দেখা গেলো, ওয়ার্ডজুড়ে ওয়ার্ডবয়দের হুড়োহুড়ি। রোগীর চাপও বেশ। মেঝেতেও শুয়ে আছেন রোগীরা। সাথে রয়েছে রোগীর স্বজনরা— একেক রোগীর সঙ্গে অন্তত ৩ থেকে ৪ জন। মেঝেতে বসেই রোগী ও রোগীর স্বজনদের দুপুরের ভাত খাওয়া ও নাস্তা-চা পানও একজায়গাতেই চলছে।

এ ওয়ার্ড ঘুরে আরও দেখা গেছে, ইট নিয়ে রোগীর সাথে ওয়ার্ডবয়দের দরদাম করতে। রোগীর আঘাতপ্রাপ্ত জায়গা হাত কিংবা পা দিয়ে ট্রাকশন (ইট) দিতে টানা দিতে হয়। আর এ টানা দেওয়ার কাজটিও করেন ওয়ার্ডবয়রা। আর প্রতি ইট বাবদ তারা রোগীর কাছ থেকে নেন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। রোগীর ওজন অনুসারে ইটের পরিমাণ নির্ভর করে। অনেক বয়স্ক রোগীর দুই থেকে তিনটা ইটেরও প্রয়োজন হয়। সেখানে ইট নিয়ে দরদামও করতে দেখা গেছে ওয়ার্ডবয়দের।

ওয়ার্ডের নার্সদের নির্ধারিত রুমে দেখা গেল মাত্র তিন জন নার্সকে। এদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা রোগীর কী ড্রেসিং করব? ওয়ার্ড বয়দের সার্জারির দাপটে রোগীর কাছে যাওয়া যায় না। আর চিকিৎসকরাও ওয়ার্ড বয়দের বিরুদ্ধে কিছু বলেন না।’

অর্থোপেডিকস সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান চন্দন কুমার দাশের কাছে বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি সার্জারির দায়িত্বে ওয়ার্ডবয়দের থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘ওয়ার্ডবয়রা ডাক্তার, নার্সদের সহায়তা করে মাত্র।’

অন্যদিকে বিভিন্ন একাডেমিক কাজে ব্যস্ত থাকায় ওয়ার্ডে ঠিকমত সময় দিতে পারেন না বলেও জানান চন্দন কুমার দাশ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!