চট্টগ্রামে করোনার গণটিকাদান কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষ অন্তহীন দুর্ভোগ ও হয়রানির শিকার হওয়ার পর জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে বেশ জোরালোভাবেই প্রশ্ন উঠছে। এক্ষেত্রে করোনার টিকাদানে জনপ্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতা অতটা কার্যকর হবে নাকি উল্টো দুর্ভোগ বাড়াবে— এমন প্রশ্নও উঠছে।
শনিবার (৭ আগস্ট) চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে হাজার হাজার মানুষ ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও টোকেন না পেয়ে ঘরে ফিরেছেন হতাশ হয়ে। কেন্দ্রপ্রতি ৩০০ টিকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যেক টিকা কেন্দ্রে হাজির ছিল হাজারেরও বেশি মানুষ। দিনশেষে অভিযোগ ওঠে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ঘনিষ্ঠজন ছাড়া খুব কম মানুষের ভাগ্যেই জুটেছে টিকা।
টিকাদান নিয়ে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করেছেন অনেকেই। নগরীর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডে খোদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহবায়ক মো. ইউনুস নিজের টাইমলাইনে লিখেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা আপার উপহার, কোভিডের ফ্রি টিকা গ্রহণের অধিকার সবার। কিন্তু টিকা পেল শুভেচ্ছা কার্ডধারীরা।’
ওই পোস্টেই কাউন্সিলরের শুভেচ্ছা কার্ড প্রসঙ্গে ক্ষোভ তুলে ধরে তিনি লিখেন, ‘টিকা গ্রহণ করতে কী লাগে? ১. জাতীয় পরিচয়পত্র ২. টিকার নিবন্ধন কার্ড। সরকারিভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাধারণ জনগণকে টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করতে ৭ আগস্ট থেকে সারা বাংলাদেশে ফ্রি টিকা গ্রহণের কথা বলা হলেও চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৭নং পশ্চিম বাকলিয়াসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে টিকা কার্ড থাকার পরেও অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক টিকা গ্রহণ করতে গিয়ে ফেরত এসেছেন। যাদের কাছে কাউন্সিলর কর্তৃক প্রদানকৃত শুভেচ্ছা কার্ড আছে কেবল তারা টিকা গ্রহণ করতে পেরেছেন।’
এমন কাণ্ডে নাগরিকদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে মন্তব্য করে মো. ইউনুস আরও লিখেন, ‘কাউন্সিলরের মনগড়া সিদ্ধান্তের কারণে শোকের মাসে বঙ্গবন্ধু ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বিদ্রুপ মন্তব্য শুনতে হচ্ছে। ৬ তারিখ শুভেচ্ছা কার্ড দিয়ে রাতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেওয়ার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে? শুভেচ্ছা কার্ড দিয়ে যদি টিকা দিবেন, তাহলে এলাকায় মাইকিং করে পূর্বেই বলে দিতেন। এলাকার সাধারণ মানুষেরা সবাই তো ফেসবুক ব্যবহার করে না।’
‘টোকেন’ দেওয়ার বিষয়টি অবশ্য সরাসরি না বললেও ‘সিরিয়াল’ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন চসিকের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোবারক আলী। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেছেন, ‘স্বাভাবিকভাবে মানুষজন এলে টিকা কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা কঠিন হবে। এসব ভেবে আমরা কেন্দ্র প্রতি ২০০ মানুষকে আগে থেকে সিরিয়াল দিয়েছি। এটা একটা সিরিয়াল, টোকেন নয়। আরবান ভলন্টিয়ারদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে বয়োবৃদ্ধদের এটি দেওয়া হয়েছে। যাতে তাদের টিকা নিতে অসুবিধা না হয়। আর বাকি ১০০ আমরা কেন্দ্রে আসা মানুষজনদের মধ্য থেকে দেবো— এমনটাই পরিকল্পনা ছিল।’
বেশিরভাগ ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের এমন শুভেচ্ছা কার্ড, টোকেন কিংবা সিরিয়াল দেওয়া হলেও এক্ষেত্রে লালখানবাজার ওয়ার্ড ছিল ব্যতিক্রম। তবে এদিন অন্যান্য ওয়ার্ডে কেন্দ্রের বাইরে ভীড় থাকলেও লালখানবাজারে দেখা গেছে এর উল্টো চিত্র। টিকাদান কেন্দ্রের ভেতরেই গিজগিজ করছিল মানুষ। যেখানে ছিল না ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধির বালাই।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তেমনই একটি ছবির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু হাসনাত মো. বেলাল বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে ৬ দিনে ৩৬০০ মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য নিবন্ধন করাতে। শেষ মুহূর্তে সেটা যখন ৯০০ হয়ে গেল, তখন তো স্বাভাবিকভাবেই একটা চাপ তৈরি হয়েছে। ৬০-৭০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে আগের রাতে অনেক চেষ্টা করেও আমরা কোনভাবেই সমন্বয় করতে পারছিলাম না। পরে আমরা ঘোষণা দিয়ে দিলাম ৭ তারিখ যে আগে কেন্দ্রে আসবে সে আগে টিকা পাবে। কোনো টোকেন দেবো না।’
তিনি বলেন, ‘পরেরদিন সকাল ৭ টা থেকেই কেন্দ্রের সামনে ব্যাপক ভীড়। তখন আমরা বেছে বেছে ৩০০ মানুষ কেন্দ্রে ঢুকিয়ে ফেললাম। বাকিদের সব বুঝিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে বলি। তাই কেন্দ্রের ভেতর ভীড় ছিল। তবে সেখানে ছবিতে যারা ছিল সকলেই টিকা পেয়েছে।’
তবে জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে বেশ জোরালোভাবেই প্রশ্ন উঠছে একদিনের টেস্ট রানে। এক্ষেত্রে করোনার টিকাদানে জনপ্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টটা অতটা কার্যকর হবে নাকি উল্টো দুর্ভোগ বাড়াবে— এমন প্রশ্নও উঠছে বেশ জোরালোভাবে। তবে এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কী ভাবছে সেটি এখন পর্যন্ত জানা যায়নি।
এসব বিষয়ে কথা বলতে দফায় দফায় চেষ্টা করেও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এআরটি/সিপি