‘টার্গেট’ করোনা রোগীরাই —নতুন রোগ ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ জেনে নিন লক্ষণ ও করণীয়

করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগিদের মধ্যে নতুন এক ধরনের সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশন নামে এ সংক্রমণটিকে চিহ্নিত করছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেখানকার চিকিৎসকরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বাড়ার মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করছে এই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশন।

কোভিড ভাইরাসের কারণে যখন রোগীর শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি কম থাকে, তখন সেই ব্যক্তি ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশনে আক্রান্ত হলে সেটি মুহূর্তের মধ্যেই মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরণের সমস্যাগুলোই করোনা-পরবর্তী সময়ে নতুন সংকট তৈরি করতে পারে। এগুলোকে তারা পোস্ট কোভিড বা লং কোভিড সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করছেন।

এই ফাঙ্গাল ইনফেকশন অবহেলা করলে মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে। ত্বকের সমস্যা হয়ে শুরু হলেও এই সংক্রমণ ছড়াতে পারে ফুসফুস এবং মস্তিষ্কে। ভারত সরকার এই রোগ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে একটি নির্দেশিকা বার করেছে। নির্দেশিকা অনুযায়ী কোভিডের সঙ্গে লড়াই করার জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, অনেকেরই সেই কারণে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কমে আসছে। তাই অন্য নানা রোগ সহজেই আক্রমণ করতে পারছে।

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশন আসলে কী?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক লেলিন চৌধুরী জানান, মানুষের শরীরে অনেক ধরণের ইনফেকশন হতে পারে – এবং এগুলো হতে পারে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ফাঙ্গাস থেকে। মূলত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিপর্যস্ত হলে শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ফাঙ্গাস এই ইনফেকশনগুলো শুরু করে এবং সে কারণেই কোভিডের পর এ ধরণের প্রবণতা বেশি হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘করোনার লক্ষ্মণ ও প্রভাবের কোনো শেষ নেই। মজা করে বলা হলেও এটি সত্যি যে প্রেগন্যান্সি আর ফ্র্যাকচার ছাড়া আর সব কিছুই করোনার লক্ষ্মণ হতে পারে। মানসিক রোগ থেকে শুরু করে হার্ট বা মস্তিষ্ক – কোন কিছুই এর বাইরে নয়। আবার পোস্ট-কোভিড সম্পর্কিত সমস্যাকে এখন লং কোভিড বা দীর্ঘমেয়াদী কোভিড বলা হচ্ছে।’ ‘অর্থাৎ করোনাভাইরাস সেরে গেলেও নতুন করে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। ফাঙ্গাস ইনফেকশন তারই একটি।

এই চিকিৎসক জানান- রক্ত, চামড়া, মুখ, নখসহ শরীরের নানা জায়গায় ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশন হতে পারে এবং সাধারণত রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এটি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কেন হয়?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন বলছেন, করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় অতিরিক্ত স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয় বলে পরবর্তীতে ‘মিউকোরমাইকোসিস’ বা এ ধরনের কালো ফাঙ্গালের ইনফেকশন হতে পারে। তিনি বলেন, রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসক প্রয়োজনীয় সব ওষুধ দিতে পারেন। তবে তারপরেও সতর্ক থাকতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোন ওষুধে কী ধরণের নির্দেশনা দিয়েছে সেটিও দেখতে হবে।

‘বিজ্ঞানীদের পরামর্শকে বিবেচনায় নিতে হবে। না হলে এ ধরনের ফাঙ্গাল ইনফেকশন ভবিষ্যতে বড় আকারের সমস্যায় রূপ নেয়ার আশংকা আছে,’ বলছিলেন তিনি। মুশতাক হোসেন বলেন, যেসব রোগী আইসিইউতে যাচ্ছেন তাদের অনেক সময় স্টেরয়েড দিতে হয়, কিংবা এর আগেও চিকিৎসক এটি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা বোধ করতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হলো এই স্টেরয়েডই পরে ফাঙ্গাল ইনফেকশন বা ছত্রাক সংক্রমণের কারণ হতে পারে। তাই এসব বিষয়ে সতর্কতার বিকল্প নেই।

ভারতীয় চিকিৎসকদের উদ্ধৃত করে সেখানকার গণমাধ্যমও বলছে যে মিউকোরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণে বেশি সমস্যায় পড়ছেন আইসিইউতে থাকা রোগীরাই। বিশেষ করে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে যাদের ডায়াবেটিস, ক্যান্সার বা হার্টের সমস্যার মতো কোন রোগ থাকে, তারাই বেশি আছেন এই সংক্রমণের ঝুঁকিতে।

মুম্বাইয়ের সিওন হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. রেনুকা ব্রাদু জানান, গত দুই মাসে তাদের হাসপাতালে ২৪ জন ছত্রাকের সংক্রমণ নিয়ে চিকিৎসার জন্য এসেছেন, গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৬। ড. রেনুকা বিবিসিকে বলেন, ওই ২৪ জন রোগীর মধ্যে ১১ জনের একটি করে চোখ অপসারণ করতে হয়েছে, এবং ছয় জন মারা গেছেন। রোগীদের বেশিরভাগই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং মধ্যবয়সী। হাসপাতালে আসার সপ্তাহ দুয়েক আগেই তারা কোভিড-১৯ থেকে সেরে উঠেছিলেন। আমরা এখন সপ্তাহে দুই থেকে তিনজন এমন রোগী পাচ্ছি। মহামারীর মধ্যে এটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো–বলেন ড. রেনুকা।

ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের লক্ষণ
চোখে বা নাকে ব্যথা, লাল হয়ে ফুলে যাওয়া, জ্বর, মাথা ব্যথা, কাশি, নিঃশ্বাসের সমস্যা রক্তবমি, অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থা। কোভিড-রোগী, ডায়াবেটিক রোগী বা যাদের রোগ-প্রতিরোধক ক্ষমতা কম, তাদের মধ্যে এই রোগের আশঙ্কা কখন? তারও একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে ভারত সরকারের নির্দেশিকায়। এর মধ্যে রয়েছে, নাক বন্ধ হয়ে আসা, নাক থেকে চাপা রক্তের মতো বা কালো পুঁজ বেরনো, চোয়ালে ব্যথা, মুখের এক দিকে ব্যথা, অবশ হয়ে যাওয়া বা ফুলে যাওয়া, নাকের উপর কালচে দাগ, দাঁতে ব্যথা বা দাঁত আলগা হয়ে আসা, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, বা দু’টো করে জিনিস দেখা, জ্বর, ত্বকের সমস্যা, বুকে ব্যথা, নিঃশ্বাসের সমস্য বেড়ে যাওয়া।

কী করবেন
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা। পুঁজ বেরনোর পর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা মাপা। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রেও তাই। সঠিক পরিমাণে এবং ঠিক সময় স্টেরয়েড নেওয়া। অক্সিজেন থেরাপির সময় পরিষ্কার, স্টেরিলাইজ করা জল ব্যবহার করা (হিউমিডিফায়ারে)। প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক এবং অ্যান্টি ফাঙ্গাল ওযুধ খাওয়া।

কী করবেন না
লক্ষণগুলি খেয়াল রাখা, অবহেলা না করা। নাকে কালচে দাগ দেখলেই আতঙ্কিত না হওয়া, বিশেষ করে যে কোভিড রোগীদের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কম। ফাঙ্গাসের উপস্থিতি বুঝতে প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষা করতে ভয় না পাওয়া (কেওএইচ স্ট্রেনিং, মাইক্রোস্কোপি, কালচার ইত্যাদি)। চিকিৎসা শুরু করতে দেরি না করা।

সতর্ক থাকুন
ডাক্তারদের মতে, এই রোগ বহুদিন ধরেই রয়েছে। আইসিইউ’র রোগীদের, যাদের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা কম।

এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!