টাকা পাচারে চট্টগ্রামে বউ-জামাই-শ্বশুরের পারিবারিক চক্র, ব্যাংকও পাবে ২৫০ কোটি টাকা

বিদেশে বিভিন্ন সময়ে ৪১ কোটি টাকা পাচারে জড়িত চট্টগ্রামের কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম বেরিয়ে এসেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে। চট্টগ্রামের বাসিন্দা যাদের নাম তালিকায় এসেছে, তারা সকলে একই পরিবারের। এরা গত বছর দেশ থেকে পালিয়ে লন্ডন চলে গেছেন। টাকা পাচারে জড়িত একমাত্র যে প্রতিষ্ঠানের নাম সিআইডির প্রতিবেদনে এসেছে, সেটিও ওই একই পরিবারের মালিকানাধীন।

এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও দুবাইয়ে টাকা পাচার করেছেন— এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে সিআইডির সবশেষ প্রতিবেদনে।

টাকা পাচারের তালিকায় রয়েছেন চট্টগ্রামের খুলশীর নাজমুল আবেদীন ও তার স্ত্রী সোহেলা আবেদীন এবং পাহাড়তলী এলাকার একেএম জাহিদ হোসেনসহ অজ্ঞাত আরও চার থেকে পাঁচজন। জাহিদ হোসেন নাজমুল আবেদীনের শ্বশুর। এছাড়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে নাম রয়েছে চট্টগ্রামের ‘এ অ্যান্ড বি আউটারওয়্যার অ্যান্ড নর্ম আউটফিট অ্যান্ড একসেসরিজ লিমিটেডের’। এই প্রতিষ্ঠানটিও নাজমুল আবেদীন ও তার পরিবারের মালিকানাধীন।

সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মোট ৪০ কোটি ৮৫ লাখ ১০ হাজার টাকা বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন।

বাংলাদেশের কত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সুইস ব্যাংকসহ অন্যান্য বিদেশি ব্যাংকে কত টাকা পাচার করেছেন, হাইকোর্ট সে বিষয়ে তথ্য জানতে চাওয়ার পর সিআইডি এই প্রতিবেদন দিল।

টাকা পাচারের তালিকায় নাম আসা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নাজমুল আবেদীন তার স্ত্রী ও শ্বশুরসহ গত বছরের মাঝামাঝিতে লন্ডন পালিয়ে যান। চট্টগ্রামের ইপিজেডে অবস্থিত তার দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে চার ব্যাংকের আটকে রয়েছে ২৪৫ কোটি টাকা।

চট্টগ্রামের খুলশী এলাকার ৬ নম্বর রোডের বে গ্রিন ভ্যালি ভবনের বাসিন্দা মোস্তফা আনোয়ার হোসেনের ছেলে নাজমুল আবেদীন ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম ইপিজেডে এঅ্যান্ডবি আউটওয়্যার নামে একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মধ্য দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ২০১৭ সালের শেষ দিকে তিনি তার স্ত্রী সোহেলা আবেদীন ও শ্বশুর একেএম জাহিদ হোসেনের নামে কিনে নেন নর্ম আউটফিট অ্যান্ড এক্সেসরিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। পরবর্তী সময়ে কোল্ড প্লে স্কুল প্রোডাক্ট নামে প্রতিষ্ঠা করেন আরেকটি কারখানা।

এই তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নাজমুল আবেদীন ব্যাংক থেকে ঋণ নেন দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে। এর মধ্যে এঅ্যান্ডবি আউটওয়্যারের কাছে ব্র্যাক ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার পাওনা ১০২ কোটি টাকা। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট পাবে ৬০ কোটি টাকা। এছাড়া নর্ম আউটফিটের কাছে ওয়ান ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা ৫৪ কোটি এবং এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা পাবে ২৯ কোটি টাকা। এর বাইরে ওই তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে স্থানীয় সরবরাহকারীরা পাবেন আরও অন্তত ৫০ কোটি টাকা।

দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর নাজমুলের মালিকানাধীন এঅ্যান্ডবি আউটওয়্যার ও নর্ম আউটফিট লিমিটেড চলতি বছরের শুরুতে নিলামের মাধ্যমে ২৫ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

সাত মামলায় ৩১১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য

এদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তদন্তাধীন সাত মামলায় বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ৩১০ কোটি ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৮ টাকা পাচারের তথ্য হাইকোর্টকে দিয়েছে সিআইডি।

এর মধ্যে রয়েছেন যুবলীগের বহিস্কৃত নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর একেএম মোমিনুল হক ওরফে সাঈদের নাম। তালিকায় এছাড়া রয়েছেন ফরিদপুরের বোয়ালমারীর রাজীব হোসেন রানা, নেত্রকোনার বারহাট্টার জামাল, কুমিল্লার দাউদকান্দির শরিফুল ইসলাম ও আউলাদ হোসেন, ফেনীর ছাগলনাইয়ার এনামুল হক, কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের মো. শাহজাহান বাবলু।

সিআইডি জানিয়েছে, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগী এনামুল হক আরমানের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরে ২৩২ কোটি ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯১ টাকা পাচারের তথ্য মিলেছে। অন্যদিকে যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরে, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় ৮ কোটি ৮৩ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯৮ টাকা পাচারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর একেএম মোমিনুল হক ওরফে সাঈদ ২৪ কোটি ৯৯ লাখ ৮২ হাজার ৩৫৯ টাকা, ফরিদপুরের রাজীব হোসেন রানা ও নেত্রকোণার বারহাট্টার জামাল সিঙ্গাপুরে ৮১ লাখ টাকা, কুমিল্লার দাউদকান্দির শরিফুল ইসলাম ও আউলাদ হোসেন ৮৩ লাখ টাকা, কুমিল্লার মো. শাহজাহান বাবলু ২১ লাখ টাকা পাচার করেছেন বলে সিআইডির ভাষ্য।

টাকা পাচারের ঘটনায় চট্টগ্রাম ও ঢাকার সাতটি মামলা তদন্তাধীন উল্লেখ করে সিআইডি জানিয়েছে, টাকা উদ্ধারের পদক্ষেপ হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশ সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দুবাই ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠানো হয়েছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!