টাকা ছাড়লেই পাসপোর্ট মেলে চট্টগ্রামের বরইতলায়, হয়রানি যতো অফিসেই

চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসের সামনে একটি চায়ের দোকান। সেখানে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকজন গল্প করছেন। তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন ঢুঁ মারছেন পাসপোর্ট অফিসের মূল গেটে। ওই গেটে আছেন একজন বৃদ্ধা। নাম আনু। গেটের সামনেও দাঁড়িয়ে কয়েকজন। এদের কাছে দালালের কথা জিজ্ঞাসা করতেই আনুকে দেখিয়ে দিলেন। আনুকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, পাসপোর্ট করতে চাইলে বরইতলায় চলে যান। কোন ঝামেলা নাই। টাকা বেশি যাবে আর কি? (এই কথাগুলো বুড়ি চট্টগ্রামের ভাষায় বলেন)।

বৃদ্ধা আনুর মতোই পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে বেশ কয়েকজন আছেন, যারা বরইতলার খোঁজ দেন। বরইতলার অফিসের লোকজন সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি ফি নিয়ে কম সময়ে পাসপোর্ট করিয়ে দেন। সরকারি নিয়ম মেনে ফরম পূরণ, ব্যাংকে টাকা জমা দেয়াসহ অনান্য কাজে পাসপোর্ট অফিসের স্টাফদের দ্বারা হয়রানি হওয়ায় সাধারণ মানুষ এসব দালালদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেন। আর এ সুযোগে দালালরা মাসে কামান লাখ টাকা। আর এ টাকার ভাগ যায় পাসপোর্ট অফিসের পিয়ন থেকে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পকেটে। যদিও এ অভিযোগ বরাবরের মতই কর্তাব্যক্তিরা অস্বীকার করে আসছেন।

২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মেশিন রেডিবল পাসপোর্ট (এমআরপি) বিতরণের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পাসপোর্টের জন্য আবেদন পড়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯৬৯টি। বিতরণ করা হয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৮২৩টি। পেন্ডিং রয়েছে ৪ হাজার ৯৯৮টি।

একরামউল্লাহ। অফিস পাসপোর্ট অফিসের সামনে বরইতলায় কাঁচ দিয়ে ঘেরা সুসজ্জ্বিত তার অফিস। এ জে এন্টারপ্রাইজ নামে এই অফিসের দেয়ালে এমআরপি ও ই-পাসপোর্টের দরদাম লেখা আছে। কম্পিউটার, প্রিন্টিং মেশিন সবই আছে।

একরামউল্লাহকে এই অফিসে কি কাজ করা হয় জিজ্ঞাসা করলে জানান, তিনি কন্ট্রাকটারি ব্যবসা করেন। তাহলে পাসপোর্টের দরদাম, লোকজনের আসা-যাওয়া, এসব কেন? এর উত্তরে তিনি জানান, আমি পরোপকারী মানুষ। যারা পাসপোর্ট করতে আসেন, তাদের ফরম পূরণ করে দিই। অনেকে পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে হয়রানি হন। ফরম পূরণ করতে জানেন না। আমরা সেটাই করে দিই। কেউ খুশি হয়ে চা-নাস্তা খাওয়ার টাকা দিলে আমি নেই।

কিন্তু বাস্তব চিত্র তার কথার সাথে মিলে না। সরেজমিন কয়েকদিন পাসপোর্ট অফিসের সামনে অবস্থান করে দেখা গেছে, পাসপোর্ট অফিসে কেউ পাসপোর্ট করতে আসলে অফিসের সামনে থেকে একরামউল্লাহর নিয়োজিত ৮/১০ জনের একটা দল তাকে বরইতলার অফিসে নিয়ে আসে। সংক্ষিপ্ত সময়ে পার্সপোর্ট করিয়ে দেয়ার কথা বলে বাড়তি টাকা নিয়ে নেন। ফরমপূরণ, অফিসে জমা, ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া সব করা হয় বরইতলার অফিস থেকে। চুক্তিতে একরাম সীমিত সময়ে পাসপোর্ট করে দেয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। এভাবেই দালালকে টাকা দেওয়ার বিনিময়ে খুব সহজেই মিলছে বাংলাদেশি নাগরিকতার অন্যতম পরিচয়পত্র পাসপোর্ট। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কোন ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরি করে নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। একই অবস্থা বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিকদের ক্ষেত্রেও।

অভিযোগ আরও রয়েছে, পাসপোর্টের ভেরিফিকেশনের সময় পুলিশ আবেদনকারীর উল্লেখ করা ঠিকানায় গিয়ে যাচাই-বাছাই করার কথা থাকলেও বেশিরভাগ সময়ই দালালদের প্ররোচনায় পুলিশ তা করে না। বরং দালালদের মধ্যস্থতায় আবেদনকারীকে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার সাথে দেখা করিয়ে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে শহরে বসেই ভেরিভেকেশনের কাজ সম্পন্ন করা হয়।

ভেরিফিকেশন ছাড়াই পাসপোর্ট হাতে পাওয়া একাধিক ব্যক্তির খোঁজ দালাল অফিসে গিয়ে পাওয়া গেছে। যারা দালালকে বাড়তি টাকা দিয়েই পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। তাকে কিছুই করতে হয়নি। পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসে দালালদের নামের খাতায় যাদের নাম রয়েছে তাদের বেশিরভাগ সেখানে দায়িত্ব আনসার সদস্য। তারা হলেন- মোজাম্মেল, রাজিব, বাবুলি, সাইফুল, হাসান, জাহাঙ্গীর।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের দালালদের অনেকে ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। তারা জানায়, ভেরিফিকেশন ছাড়া তার মাধ্যমে একটি সাধারণ পাসপোর্ট তৈরি করতে হলে ৫ হাজার টাকা দিতে হবে। আর পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ হলে দিতে হবে ৭ হাজার ৩০০ টাকা। জরুরি ভিত্তিতে কোন পাসপোর্ট করতে হলে ১২ হাজার টাকা দিতে হবে। কোন ধরনের হয়রানি ছাড়াই পাসপোর্ট হাতে পেয়ে যাবে আবেদনকারী।

জানা গেছে, পাসপোর্ট অফিস থেকে ই-পাসপোর্ট (ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট) পেতে আবেদনকারীকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এক মাস কিংবা দেড় মাসের আগে অনেক গ্রাহক হাতে পাচ্ছেন না পাসপোর্ট। এমআরপি পাসপোর্টের ক্ষেত্রে সময় আরও বেশি। তাই লোকজন বাধ্য হয়েই দালালকে বাড়তি টাকা দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করছেন।

পাসপোর্ট অফিস সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে ৫ ও ১০ বছর মেয়াদের জন্য ই-পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছে। অনলাইনে ই-পাসপোর্টের আবেদন জমা দেয়া যাচ্ছে। ৫ বছর মেয়াদি ৪৮ পাতার পাসপোর্ট স্বাভাবিক সময়ে (সাধারণ) ২১ কর্মদিবসে পেতে জমা দিতে হবে ৪ হাজার ২৫ টাকা। একই পাসপোর্ট এক্সপ্রেস ডেলিভারি অর্থাৎ ১০ কর্মদিবসে পেতে লাগবে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা। ২ কর্মদিবসে পেতে লাগবে ৮ হাজার ৬২৫ টাকা। ১০ বছর মেয়াদি ৪৮ পাতার পাসপোর্ট ২১ কর্মদিবসে পেতে জমা দিতে হবে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা। ১০ কর্মদিবসে পেতে লাগবে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা। ২ কর্মদিবসে পেতে লাগবে ১২ হাজার ৭৫ টাকা। তবে ২ দিনের পাসপোর্ট চট্টগ্রাম থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।

গত বছরের জুলাই থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন জমা পড়েছিল ৬ হাজার ৩০৮টি। এর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে হয়েছে ১ হাজার ৬৭৪টি। আর বিতরণের জন্য প্রস্তত আছে ৭৫২টি। বড়ইতলা ছাড়া ও পাঁচলাইস্থ সোনালী ব্যাংকের সামনেও প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে দালাল চক্র। তারা নিজেরাই আগবাড়িয়ে এসে পাসপোর্ট করতে আসা লোকজনের সাথে আলাপ জমান। তারপর খুব কম সময়ে পাসপোর্ট করিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন। সোনালী ব্যাংকের সামনে যারা থাকে তাদেরও রয়েছে ছদ্মনাম। নাম জানতে চাইলে কেউ আসল নাম বলেন না। এদেরই একজন হারুন। তার অফিস সোনালী ব্যাংকের সাথেই। আর যারা এসব দালালদের পাশ কাটিয়ে নিজেরাই আবেদন ফরম জমা দিতে যান, তাদের অবেদনটি সঠিক থাকলে ও কোনো না কোনো ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে তা ফেরত দেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাই বাধ্য হয়ে এসব দালালদের কাছে ধর্না দিতে হয় আবেদনকারীদের। দালালরা একটা বিশেষ চিহ্ন দেয়, এ চিহ্ন দেয়া আবেদনপত্র দেখলেই সঙ্গে সঙ্গেই তা গ্রহণ করে নেওয়া হয়। এভাবেই দালালের দেওয়া বিশেষ চিহ্নের মাধ্যমে অনায়াসেই মিলে যায় পাসপোর্ট।

আরও জানা গেছে, এমআরপি সাধারণ পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ৩ হাজার ৪৫০ টাকা সরকারি ফি হলেও এক্ষেত্রে দালালরা নিয়ে থাকে সাড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে নেওয়া হয় অতিরিক্ত ১১ শত টাকা। জরুরি পাসপোর্টের ক্ষেত্রে সরকারি ফি ৬ হাজার ৯০০ টাকা হলেও দালালরা ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা নেন।

পাঁচলাইশস্থ চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মাসুম হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, দালালদের তৎপরতা রোধে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অভিযান চালিয়েছি। আর লোকজন দালালদের কাছে যাবে কেন? নিজে এসে সব নিয়মানুযায়ী প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে ফরম পূরণ করে জমা দিবে, ব্যাংকে টাকা জমা দিবে। পাসপোর্ট পেয়ে যাবে। দালালমুক্ত করার জন্য পুরো ভবনটি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে বলেও জানান মাসুম হাসান।

এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!