টাকার বিনিময়ে তারা নিঃসন্তানের কোলে সন্তান তুলে দেয়

হাসপাতাল কেন্দ্রিক বাচ্চা চোরচক্র, গ্রেপ্তার ৩

আব্দুল গাফফার। বাড়ি সিলেট, তবে পেশার কারণে চট্টগ্রামে থাকেন। তিনি একজন গাড়িচালক। তার প্রথম সংসারে তিন কন্যা সন্তান হওয়ায় পুত্র সন্তানের জন্য আরেকটা বিয়ে করেন চট্টগ্রামের সিতাকুণ্ডের শেফালীকে। ওই সংসারে তিনটি কন্যা সন্তানের পর আসে একটি পুত্র। যার নাম রাখা হয় মোহাম্মদ আলী। আলীর বয়স এখনো এক বছর হয়নি। এরমধ্যে চুরি হয় মোহাম্মদ আলী। শিশু চোরচক্রের হাতে পড়ে আলী। দুইমাসের আলী পায় নতুন মা বাবা। নিজের মা-বাবার কোল খালি করে টাকার বিনিময়ে শিশুটিকে অন্যের হাতে তুলে দেয় চক্রটি।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালকে কেন্দ্র করে বাচ্চা চুরির এমন একটি চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এই চক্রের সদস্যরা বাচ্চা চুরি করে চুক্তির মাধ্যমে কোনো নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করে দেয়।

রোববার (৩ নভেম্বর) বিকাল ৩টায় তাদের গ্রেপ্তারের পর কোতোয়ালী থানায় এক সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) এসএম মেহেদী হাসান এসব তথ্য দেন।

মেহেদী হাসান বলেন, আমরা বাচ্চা চুরি করে চুক্তির মাধ্যমে নিঃসন্তান দম্পতির কাছে বিক্রি করে এমন এক চক্রের সন্ধান পেয়েছি। তারা বিভিন্ন হাসপাতালের আয়া-নার্স ও দালাল এবং বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মচারীদের যোগসাজশে এই সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। হতদরিদ্র মানুষ বিশেষ করে নারীদের কাছ থেকে বাচ্চা চুরি করে চুক্তির মাধ্যমে এরা নিঃসন্তান দম্পতিদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

চুক্তির সময় বাচ্চার মা-বাবা মারা গেছে এবং বাচ্চাটি তাদের নিকটাত্মীয়ের বলে জানায়। এতে এই নিঃসন্তান দম্পতিরা সেই বাচ্চা কিনে লালন-পালনে উৎসাহিত হয়।

কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন জানান, গত ২৭ মে নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকায় কোলে দুইমাসের শিশু নিয়ে ভিক্ষা করছিলেন শেফালী বেগম। এক যুবক তাদের ভালো পোশাক কিনে দেয়ার কথা বলে রিয়াজউদ্দিন বাজারে নিয়ে যায়। সেখান থেকে কৌশলে শিশুটিকে চুরি করে নিয়ে যায় সে। এ ঘটনায় শেফালী ২৮ মে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার তদন্তের সূত্রে শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে কক্সবাজার কলাতলী থেকে আফসার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আফসারের দেওয়া তথ্যে চট্টগ্রাম নগরীর মেহেদীবাগে ন্যাশনাল হাসপাতালের সামনে থেকে সুজিত এবং নগরীর অক্সিজেন এলাকার সৈয়দপাড়ায় এক বাসা থেকে পারভীন আকতারকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী নগরীর দামপাড়ার পল্টন রোডে পবন কান্তি নাথের বাসা থেকে চুরি যাওয়া শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়।

নিঃসন্তান পবন কান্তি নাথ এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় আফসারের কাছ থেকে বাচ্চাটি কিনে নেন। বাচ্চা দত্তক নেওয়ার সময় আফসারের সঙ্গে ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তিও হয়।

Baby-thief,-arrested-2

পুলিশ জানায়, দুইমাস আগে ইপিজেড থানায় একটি শিশু চুরির মামলায় মো. ইকবাল হোসেন (২৮) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশকে সে জানায়, সে (ইকবাল) ও আফসার দু’জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় থাকে। রোগীর রক্ত লাগলে কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তারা টাকার বিনিময়ে সহযোগিতা করে।

এদিকে শনিবার (২ নভেম্বর) কক্সবাজার কলাতলী থেকে আফসারকে গ্রেপ্তারের পর সে জানায়, এ পর্যন্ত সে ৭-৮টি বাচ্চা চুরি করেছে। প্রতিটি বাচ্চা বিক্রি করে সে ১০ হাজার টাকা করে পেয়েছে।

কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান বলেন, বাচ্চাটি চুরি করে ইকবাল ও আফসার নামে দুজন। এরপর শিশুটিকে পারভীনের হেফাজতে রাখা হয়। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পরীক্ষায় দেখা যায়, ইকবাল বাচ্চাটিকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আফসার ও ইকবালের সঙ্গে হাসপাতালের আয়া-নার্স এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মচারীদের ভালো যোগাযোগ আছে। হাসপাতালে অনেক নিঃসন্তান নারী আয়া-নার্সদের কাছে দত্তক নেওয়ার জন্য বাচ্চা চান। তখন আয়া-নার্সরা আফসার ও ইকবালদের মতো দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এ চক্রটি দুইভাবে বাচ্চা সংগ্রহ করে। প্রথমত, অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের পর প্রসব করা বাচ্চা তারা নিয়ে নেয়। দ্বিতীয়ত, তারা বাচ্চা চুরি করে বিক্রি করে।

মোহাম্মদ আলীর বাবা জানান, আমি একটা ছেলের জন্য অনেক অপেক্ষা করেছি। আর সেই ছেলেকে হারিয়ে আমি আর তার মা পাগলের মতো হয়ে পড়ি। আজ প্রায় ছয় মাস পর আমরা আলীকে ফিরে পেয়েছি । এজন্য পুলিশের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।

মা শেফালী বলেন, আমার ছেলেকে আমি অনেকদিন পর ফিরে পেয়েছি। এজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।

ছেলে চুরির ব্যাপারে তিনি জানান, গত ২৭ মে বিকালের দিকে কাজীর দেউড়ি এলাকায় আমি একটু অসুস্থ হয়ে পড়ি। একপর্যায়ে আমার বমি হলে ইকবাল আমাকে পানির বোতল কিনে দেয়। ওই পানি খাওয়ার পর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। তখন সে আমার ছেলেকে নিয়ে যায়।

এইচটি/সিআর

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!