টাকার জন্য ১৯ ঘণ্টা লাশ আটকে রাখে চট্টগ্রামের মেডিকেল সেন্টার

৩৬ দিনে বিল আসে ১৪ লাখ টাকা

করোনায় আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল মেডিকেল সেন্টারে টানা ৩৬ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যাওয়া এক রোগীর বিল এসেছে সাড়ে ১৪ লাখ টাকা। সেই বিলের সাড়ে ১০ লাখ টাকা জমা দিয়েও বাকি টাকার জন্য ১৯ ঘন্টা লাশ বুঝে পাননি শামসুন নাহার (৪০) নামের ওই নারীর স্বজনরা।

এমনকি বাকি টাকার জন্য স্বজনদের পক্ষ থেকে কয়েকদিন সময় নিয়ে একটা চেক জমা দেয়ার কথা বলা হলেও মন গলেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। পরে ১৯ ঘন্টার চরম হয়রানি শেষে আরও দুই লাখ টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকার জন্য এক সপ্তাহ মেয়াদি ব্যাংক চেক দিয়ে লাশ বুঝে নেন।

তবে যতক্ষণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মন গলে, ততক্ষণে গলন শুরু হয়েছে লাশের শরীরেও-এমনটাই জানিয়েছেন মৃতের স্বজনরা।

জানা গেছে গত ৩৬ দিন ওই হাসপাতালে থাকলেও এর মধ্যে আইসিইউ ওয়ার্ডে ছিলেন ২৫ দিন। এই ৩৬ দিনে শামসুন নাহারের শুধুমাত্র বেড ভাড়া এসেছে ২ লাখ ৩২ হাজার টাকা। বিলে ঔষধ বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার। বেড সাইড প্রসিডিওর নামে এক খাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা।

খবর নিয়ে জানা গেছে, একজন রোগীকে সার্বক্ষণিক বেডে রেখে চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে ক্যাথাডার, রাইস টিউব সহ বিভিন্ন সাপোর্টিভ ব্যবস্থাগুলোকেই বেড সাইড প্রসিডিওর বলা হয়।

এছাড়া এই সময়ের মধ্যে নার্সিং সার্ভিস চার্জ ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার। এই ৩৬ দিনে শুধুমাত্র কনসালট্যান্ট ফি এসেছে ৬০ হাজার।

এই বিলকে অযৌক্তিক এবং ভূতুড়ে বলে মন্তব্য করছেন চিকিৎসা পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তিও।

শামসুন নাহারের আত্মীয় স্বজন জানিয়েছেন, গত ৩০ জুলাই জিইসি মোড়ের মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয় তাকে। শুক্রবার (৩ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৬ টায় তিনি মারা যান বলে জানানো হয় হাসপাতাল থেকে। এ সময় তাদের ১৪ লাখ ৬২ হাজার ৬৮৪ টাকার বিল দেয়া হয়। এর মধ্যে সাড়ে ৪ লাখ টাকা আগেই জমা দিয়েছিল শামসুন নাহারের পরিবার। পরে রাত ২ টার দিকে আরও ৬ লাখ টাকা জমা দেয়ার চেষ্টা করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুরো টাকা দিয়ে লাশ বুঝে নেয়ার কথা বলে।

এ সময় তারা বাকি টাকা এই মুহুর্তে দিতে পারবে না জানিয়ে তার বদলে একটি চেক দেয়ার কথা জানালেও হাসপাতাল থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয় নগদ টাকা জমা দিয়েই লাশ নিতে হবে।

শেষে বিষয়টি গণমাধ্যমের নজরে আসায় ১৯ ঘন্টা পর শনিবার (৪ সেপ্টেম্বর) ১ টার দিকে স্বজনদের লাশ বুঝিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে তার আগে আরও দুই লাখ টাকা জমা দিতে হয় শামসুন নাহারের স্বজনদের। বাকি ২ লাখ ১২ হাজার টাকার জন্য এক সপ্তাহ সময় দিয়ে একটা চেক জমা নেয়া হয়।

শামসুম নাহারের ভাগিনা মো. রবিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার মেজো মামী মেডিকেল সেন্টারের আইসিইউতে মারা গেছেন গতকাল সন্ধ্যা ৬ টায়। আমরা এর আগে ২ লাখ, দেড় লাখ ও ১ লাখ করে পর্যায়ক্রমে সাড়ে ৪ লাখ টাকা বিল দিয়েছি। আমাদের বলা হয় মোট বিল এসেছে ১৪ লাখ ৬২ হাজার রাত দুটার দিকে আমরা ক্যাশ ৬ লাখ টাকা জমা দিই লাশ নিয়ে যেতে। কিন্তু বাকি টাকা দিতে না পারার কারণে তারা লাশ আটকে রাখে।’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মনিরুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ পেয়ে আমরা পুরো টাকা আনতে পারিনি। এখন ছয় লাখ টাকা দিচ্ছি। বাকি ৪ লাখ ১২ হাজার টাকা আমরা পরে পরিশোধ করবো। কিন্তু তিনি তা মানতে রাজি হননি। তিনি আমাদের বলছেন, টাকা নিয়ে সমস্যা থাকলে আমরা রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাইনি কেন? পরে ব্যাপারটা মিডিয়ায় জানাজানি হলে উনারা ১ টার দিকে লাশ বুঝিয়ে দেন। এর মধ্যে আমরা আরও দুই লাখ টাকা জমা দিয়েছি। বাকি টাকার জন্য একটা চেক দিয়েছি।’

এর মধ্যে শামসুন নাহারের লাশে পচন ধরতে শুরু করেছে জানিয়ে রবিন বলেন, ‘মামীর লাশের শরীর থেকে ব্লিডিং হচ্ছে। শরীরে পচন আরম্ভ হয়েছে। তবু সাংবাদিকরা কথা বলায় অন্তত লাশটা বুঝে পেয়েছি। এখন আমরা লাশ নিয়ে যাচ্ছি।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে মেডিকেল সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মনিরুজ্জামানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি।

শামসুন নাহারের বাসা চট্টগ্রামের হামজারবাগ, তার স্বামী সৌদি আরব প্রবাসী।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!