জীবনবীমার টাকা নিয়ে ঘোরায় ৬ কোম্পানি, আচরণ ভালো নয় বড় কোম্পানিরও

পলিসির মেয়াদপূর্তির পর টাকা পায় না অনেক গ্রাহকই

জীবন চলার পথে সহায় হবে ভেবে নাজিম উদ্দিন ১০ বছরের একটি জীবন বীমা পলিসি কিনেছিলেন সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি থেকে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর তিনি সব কাগজপত্র জমা দিয়ে টাকার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু সেই টাকার মুখ এখনও দেখেননি। অনেক চেষ্টার পর ২০২০ সালে কোম্পানি তাকে একটি চেক দেয়। কিন্তু সেই চেকটি ব্যাংকে জমা দেওয়ার পর দেখা যায় কোম্পানির ব্যাংক একাউন্টে টাকাই নেই।

নাজিম একা নন, বিভিন্ন জীবন বীমা কোম্পানির এরকম হাজার হাজার গ্রাহক তাদের পলিসির মেয়াদ ফুরানোর পরও ফেরত পাচ্ছেন না টাকা। অথচ বীমা আইন ২০১০ অনুসারে একটি জীবনবীমা পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে টাকা দিতে বাধ্য বীমা কোম্পানিগুলো। কিন্তু বাস্তবতা হল— এই টাকার জন্য বীমা এজেন্টদের পেছনে দৌড়াতে হয় মাসের পর মাস। ধরনা দিতে হয় এখানে-ওখানে। অপেক্ষায় কাটাতে হয় বছরের পর বছর। এরপরও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টাকা মেলে না।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন ৩৩টিরও বেশি জীবনবীমা কোম্পানি রয়েছে। প্রায় এক কোটি মানুষ এসব কোম্পানির গ্রাহক।

ছোট কোম্পানিই শুধু নয়, বড় বড় কোম্পানির বিরুদ্ধেও একই ধরনের হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। আরব আমিরাত প্রবাসী বেলায়েত হোসেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে একটি জীবনবীমা পলিসি কিনেছিলেন। ১০ বছর ধরে তিনি তার কিস্তিও দিয়ে গেছেন নিয়মিত। ২০২০ সালের এপ্রিলে সেই বীমার মেয়াদ পূর্ণ হয়। কিন্তু টাকা তিনি আর পাননি। আজ দেবে-কাল দেবে বলে ঘোরানো হচ্ছে তাকে। বেলায়েতের স্ত্রী বলছেন, ‘মানুষ তাদের জীবন সহজ করার জন্য জীবন বীমা কেনে। অথচ সেই জীবনবীমাই এখন উল্টো মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে।’

বেশি অভিযোগ ছয় কোম্পানির বিরুদ্ধে

জীবনবীমা বকেয়া নিয়ে ৭০-৮০ শতাংশ অভিযোগই মূলত ছয়টি বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে। এগুলো হল— পদ্মা, সানফ্লাওয়ার, সানলাইফ, বায়রা, হোমল্যান্ড এবং গোল্ডেন লাইফ।

এমন তথ্য জানিয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইডিআরএর জীবনবীমা বিভাগের পরিচালক শাহ আলম বলেন, ‘আমরা পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্সের বিরুদ্ধে প্রায় ১০ হাজার এবং হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রায় ৬০০টি অভিযোগ পেয়েছি। এর মধ্যে পদ্মার বিরুদ্ধে প্রায় আসা ৬ হাজার অভিযোগের নিষ্পত্তি করেছি। কিন্তু আমরা যে পরিমাণ অভিযোগ পেয়েছি, বাস্তব অবস্থা তার চেয়েও ভয়াবহ। কারণ প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ এমন ঘটনায় অভিযোগ দায়ের করতে জানে না।’

আইডিআরএর আরেক কর্মকর্তা বলেন, গ্রাহকদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর অনিয়ম দূর করতে তারা বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে একজন প্রশাসক নিয়োগ করেছে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স ধীরে ধীরে সম্পত্তি বিক্রি করে তার গ্রাহকদের টাকা দিচ্ছে। অবশ্য ফারইস্টের মতো বড় কোম্পানির ক্ষেত্রে, কখনও কখনও তাদের স্থানীয় এজেন্টরাও কিস্তি জমা না দিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফরিদ হোসেন অবশ্য দাবি করেছেন, তারা তাদের গ্রাহকদের দাবি করা অর্থের বেশিরভাগই দিয়ে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘কখনও কখনও স্থানীয় এজেন্টরা এই প্রক্রিয়াকে দীর্ঘ করে তোলে। তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতে অনেক সময় নেয়, যা টাকা দিতে দেরি হওয়ার অন্যতম কারণ। গত বছর আমরা গ্রাহকদের প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা দিয়েছিলাম।’

গ্রাহকের টাকা ভোগবিলাসে অপচয়

বীমা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে থাকে বাংলাদেশ বীমা একাডেমি। এর প্রধান ফ্যাকাল্টি এসএম ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বড় ও সচ্ছল কোম্পানির বিরুদ্ধেও বীমা দাবির টাকা পরিশোধ করার মতো অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু কী পরিমাণ গ্রাহক এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সে সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্সের একজন এজেন্ট বলেন, ‘আমার প্রায় ২৫ জন গ্রাহক তাদের টাকা পায়নি। যদিও তাদের পলিসি পূর্ণ হওয়ার পর এক থেকে তিন বছর পার হয়ে গেছে। অফিসে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, কোম্পানির এখন তহবিল সংকট আছে। কিন্তু এজেন্ট হিসেবে গ্রাহকের চাপ তো আমাকেই বহন করতে হচ্ছে।’

সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের টাকা ফেরত না দিয়ে উল্টো তাদের হয়রানি করার প্রমাণ পেয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইডিআরএ। এ বিষয়ক এক তদন্তে দেখা গেছে, এসব গ্রাহকের অনেকেরই পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে। অথচ এখনও ওইসব গ্রাহক টাকা হাতে পাননি।

তদন্তে দেখা গেছে, বিভিন্ন খাতে এই বীমা কোম্পানিটি অতিরিক্ত টাকা খরচ করে কোম্পানির বারোটা বাজিয়েছে। গ্রাহকদের টাকা দেওয়ার অবস্থাও এখন এই কোম্পানির নেই। দেখা গেছে, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ১৮৯ কোটিরও বেশি টাকা খরচ বা অপচয় করেছে। অথচ এই টাকার ৯০ ভাগই এসেছে গ্রাহকের দেওয়ার কিস্তির টাকা থেকে।

কড়া ব্যবস্থা চায় ইনস্যুরেন্স এসোসিয়েশন

বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স এসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট শেখ কবির হোসেন বলেন, তারা জানতে পেরেছেন, অনেকে পলিসি গ্রাহক মেয়াদপূর্তির এক থেকে তিন বছর পার হওয়ার পরও তাদের টাকা ফেরত পাচ্ছেন না।

তিনি বলেন, ‘এটা অপরাধ। বীমা খাতের জন্যই এটি দুঃখজনক।’

শেখ কবির হোসেন বলেন, যেসব কোম্পানি গ্রাহকদের টাকা দিচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে আইআরডিএকে।

তিনি বলেন, ‘গ্রাহকদের কাছ থেকে আমরা কিছু অভিযোগ পেলেও সংখ্যায় সেটা খুব বেশি নয়। আমরা সব কোম্পানিকে চিঠি লিখে তাদের গ্রাহকদের সময়মত টাকা দিতে অনুরোধ করেছি। যদি কোনো কোম্পানির হাতে পরিশোধ করার টাকা না থাকে, তাহলে সম্পদ বিক্রি করেই সেটা দেওয়া উচিত।’

সিপি

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অবলম্বনে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!