জিপিএইচের কারখানায় শ্রমিকের শরীরপোড়া গন্ধ, জীবনের দাম নেই

চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের কারখানাটি হয়ে উঠেছে রীতিমতো মৃত্যুফাঁদ। প্রতি বছরই সেখানে নিদারুণভাবে দগ্ধ হচ্ছে অসহায় শ্রমিকরা। গত একমাসেই এমন ঘটনা ঘটেছে পর পর দুবার। কখনও লোহার উত্তপ্ত লাভা, কখনও তরল লোহার ট্যাঙ্কে বিস্ফোরণ, এমনকি লোহার পাত পড়েও শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে সেখানে। নির্মম মৃত্যুর পাশাপাশি এসব ঘটনায় আহত হয়ে চিরজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণও করে নিতে হচ্ছে অনেক অভাবী শ্রমিককে।

কারখানার একাধিক শ্রমিক ও পার্শ্ববর্তী বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিছু কিছু ঘটনা মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে খবর হয়ে আসলেও জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় ঘটা অনেক ঘটনাই নিরবে চাপা পড়ে যায়। অনেক শ্রমিক হাসপাতাল থেকেই পোড়া শরীর নিয়ে চোখের পানি সঙ্গী করে বাড়িতে যেতে বাধ্য হন। শ্রমিকের জীবন সেখানে এতোই বিপজ্জনক।

অথচ ২০১২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া এই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত মূলধন ১ হাজার কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ৩৭৮ কোটি ১৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এমন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকের নিরাপত্তা যে কতোটুকু ঠুনকো, সেটা শ্রমিক আহত-নিহত হওয়ার ঘটনাগুলো থেকে খানিকটা আঁচ করা যায়।

জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের কারখানায় পুরো শরীরই পুড়ে যায় এই শ্রমিকের। বার্ন ইউনিটে ছুটে এসেছেন বেদনায় বাকরুদ্ধ স্বজনরা।
জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের কারখানায় পুরো শরীরই পুড়ে যায় এই শ্রমিকের। বার্ন ইউনিটে ছুটে এসেছেন বেদনায় বাকরুদ্ধ স্বজনরা।

বছর বছর অনেকটা নিয়ম হয়ে দাঁড়ানো এসব ঘটনায় প্রতিকারও পান না শ্রমিকরা। স্থানীয় পুলিশ সাধারণত সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেই দায় সারে। কোনো কোনো ঘটনায় মামলা হলেও সেগুলো আর এগোয় না। অন্যদিকে সীতাকুণ্ডের জিপিএইচ কারখানায় ঘটা এসব ঘটনাকে ‘ছোট দুর্ঘটনা’ বলে বারবার দায় এড়ানোর চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ।

গত সোমবার (১৯ অক্টোবর) ছয় শ্রমিক দগ্ধ হওয়ার মাত্র এক মাস আগেই গত ২২ সেপ্টেম্বর জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানায় লোহার উত্তপ্ত লাভায় দগ্ধ হন সাতজন। এরা হলেন শাহীন আলম (২৭), টিপু সুলতান (৩২), শহীদুল ইসলাম (২৭), নুরুজ্জামান (৪০), আমীর হোসেন (২৭), রবীন্দ্র (৪০) ও ভারতীয় নাগরিক কেওয়াল সিং চৌহান (৪৬)। কারখানায় লোহা গলানোর সময় এই সাত কর্মী দগ্ধ হন। এদের বেশিরভাগই মুখ ও হাতে দগ্ধ হন। এদের সবারই শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় পুড়ে যাওয়া শ্রমিকদের বীভৎস শরীর খালি চোখে দেখা কঠিন।
জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় পুড়ে যাওয়া শ্রমিকদের বীভৎস শরীর খালি চোখে দেখা কঠিন।

গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় দুর্ঘটনার শিকার হন আরিফ নামের এক শ্রমিক। কারখানার গলিত লোহায় প্রায় পুরো শরীর ঝলসে যায় তার। আরিফ মুন্সিগঞ্জের ক্ষির মন্দির এলাকার আল আমিন সওদাগরের ছেলে।

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর ঘটে আরও দুটি দুর্ঘটনা। জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানায় কাজ করার সময় পীযূষ দে (২৪) ও শফিউল বাশার (২৮) নামের দুজন মারাত্মক আহত হন। অন্যদিকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মো. নাজিম (২৫) নামে আরেক শ্রমিকও আহত হন। পীযূষ দে মৌলভীবাজার একা মধু থানা রাজনগরের ধীরন্দ দের পুত্র। শফিউল বাশার কুমিল্লা জেলার ছোট বারেরা থানা বরুড়া এলাকার নজরুল ইসলাম এর পুত্র ও মো. নাজিম সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া এলাকার আবুল বাশারের পুত্র।

একই বছরের ১০ এপ্রিল লৌহজাত পণ্য লোডিংয়ের সময় জিপিএইচের কারখানার শ্রমিক রণজিৎ বর্মন লোহার পাতের চাপায় মারা যান।

এর আগে ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবর সীতাকুণ্ডে জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেডের কারখানায় ফার্নেস বয়লারে (তরল লোহার ট্যাঙ্ক) বিস্ফোরণে শাহ আলম নামের এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তার শরীর দগ্ধ হয়েছিল শতভাগ। ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় কারখানার আরও ১১ কর্মী দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে ৫ জনের অবস্থা ছিল খুবই গুরুতর।

সীতাকুণ্ডে জিপিএইচ ইস্পাতের একটি কারখানা।
সীতাকুণ্ডে জিপিএইচ ইস্পাতের একটি কারখানা।

২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানায় ফার্নেস চুলার বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে কারখানার সুপারভাইজারসহ সাতজন শ্রমিক গুরুতর আহত হন। এর মধ্যে তিনজনের অবস্থা ছিল গুরুতর। ওই সময় অগ্নিদগ্ধরা হলেন কুড়িগ্রাম পুরাতন স্টেশন এলাকার শংকর কুমার রায়ের ছেলে জয়ন্ত কুমার রায় (৩৬), চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড কুমিরা মসজিদ্দা এলাকার মৃত অনু মিয়ার ছেলে আলী আশরাফ (৪১), ফটিকছড়ি নারায়ণহাট পাকানিয়া এলাকার সুলতান আহম্মদের ছেলে মো. আবু তৈয়ব (২৫), কুমিল্লা লাঙ্গলকোট হেয়াপোরা এলাকার মৃত আনিসুল হকের ছেলে সুপারভাইজার মো. শাহজাহান (৫২), গাইবান্দা পশ্চিম গুপ্ততলা এলাকার মো. আব্বাস আলীর ছেলে মো. রাসেল (২১)। দুজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।

এদিকে চলতি বছরে জিপিএইচ ইস্পাতের কারখানায় সর্বশেষ দুর্ঘটনাটি ঘটলো সোমবার (১৯ অক্টোবর) সকালে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে এটি দ্বিতীয় দফায় ফার্নেস বিস্ফোরণের ঘটনা। বিস্ফোরণের এই ঘটনায় অন্তত ছয়জন শ্রমিকের শরীর পুড়ে গেছে। এদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর এলাকার হাফেজ জাকির হোসেনের পুত্র মফিজুর রহমান (২৮), বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার গাবোনিসা এলাকার ছালাম শেখের পুত্র আবু সাঈদ (৩৭) এবং সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া মুহুরীপাড়া এলাকার রবীন্দ্র দাশের পুত্র শিমুল দাশ (২৯)।

জানা গেছে, জিপিএইচ ইস্পাত কারখানায় কর্মরত অবস্থায় হঠাৎ বিকল শব্দে কারখানার ফার্নেস বিস্ফোরিত হয়। এতে কারখানায় কর্মরত ৬ শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হন। পরে অন্যরা এসে তাদেরকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যায়। এর মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনজনের অবস্থা ভালোর দিকে থাকায় চিকিৎসকরা তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেন।

অন্যদিকে গলানো উত্তপ্ত লোহার লাভায় তিন শ্রমিক মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন। বর্তমানে তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। জানা গেছে, দগ্ধ শ্রমিকদের মধ্যে শিমুল দাশের শরীরের ৩১ শতাংশই ঝলসে গেছে। অন্যদিকে আবু সাইদের শরীর ২৪ শতাংশ এবং মফিজুর রহমানের শরীরের ১৩ শতাংশ পুড়ে গেছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!