জামায়াতের দূর্গ ভেঙে আইআইইউসির নতুন যাত্রা শুরু নদভীর নেতৃত্বে

১০০ কোটি টাকায় হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প

খোলা হচ্ছে নতুন নতুন বিভাগ। নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন হল। ছাত্রদের জন্য একটি ও ছাত্রীদের জন্য আলাদা হল নির্মাণের কাজ শুরু হচ্ছে শীঘ্রই। নতুন প্রশাসনিক ভবনের পাশাপাশি নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন অনুষদ ভবনও। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালনের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে স্থাপন করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু কর্নার ও বঙ্গবন্ধু রিসার্চ সেন্টার।

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে (আইআইইউসি) এই উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোটি কোটি টাকা নগদেই লোপাট করা হচ্ছিল এই প্রতিষ্ঠান থেকে। এই লোপাটের নেতৃত্ব দিয়েছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা। প্রতিষ্ঠানটির টাকায় চালানো হচ্ছিল জামায়াতের বিরুদ্ধে দায়ের করা শত শত মামলার কার্যক্রম। সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে জামায়াতের নির্বাচনী ফান্ডও তৈরি হতো এই প্রতিষ্ঠানের টাকায়।

আইআইইউসি ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্ণার ও বঙ্গবন্ধু রিসার্চ সেন্টার।
আইআইইউসি ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্ণার ও বঙ্গবন্ধু রিসার্চ সেন্টার।

বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানে কায়েম হয়েছিল জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর মাওলানা শামসুল ইসলামের রামরাজত্ব। তাঁর কথাই ছিল এই প্রতিষ্ঠানে ‘শেষ কথা’। নাশকতার মামলার আসামি থেকে শুরু করে শামসুল ইসলামপন্থী জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের এই প্রতিষ্ঠানে লাখ টাকা বেতন দিয়ে করা হয়েছিল পুনর্বাসনও। বিশ্ববিদ্যালয়ে এত কর্মকর্তার প্রয়োজন না থাকলেও জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের এখানে দেওয়া হয়েছে নিয়োগ। তাদের অনেকেই তাই চাকরি না করেও তুলে নিতেন বেতন। এভাবেই এই প্রতিষ্ঠানের টাকা হরিলুটই যেন করেছেন জামায়াতের নেতারা। আইআইউসির চিত্র ছিল এমনই।

কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতের সেই পরিস্থিতি এখন নেই। চট্টগ্রাম সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সাংসদ প্রফেসর ড. আবু রেজা নদভীর নেতৃত্বে গত তিন মাসে জামায়াতের একাডেমিক ও আর্থিক এই দূর্গ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে হয়েছে একাডেমিক পরিবেশ। খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ট্রাস্টি বোর্ড।

বিভিন্ন নাশকতার ঘটনায় জড়িত জামায়াত নেতাদের প্রশাসনের সব স্তর থেকে দেওয়া হয়েছে অব্যাহতি। এসব জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রগতিশীল স্কলারদের। ঢেলে সাজানো হয়েছে একাডেমিক সেক্টর। অবকাঠামো উন্নয়নে হাতে নেওয়া হয়েছে ১০০ কোটি টাকা প্রকল্প। গবেষণাখাতে আমুল পরিবর্তনের লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ। অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে বিভিন্ন পর্ষদ ও কমিটি গঠন করা হয়েছে নতুন করে। ক্যাম্পাসে উদযাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা ও সেমিনার। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে আইআইইউসির সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের রেল যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ক্যাম্পাসে রেলস্টেশন নির্মাণে নেওয়া হয়েছে প্রাথমিক উদ্যোগ। যে ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামই নেওয়ার সুযোগ ছিল না প্রতিষ্ঠার পর সে ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এখন বঙ্গবন্ধু কর্ণার ও বঙ্গবন্ধু রিসার্চ সেন্টার। সাংসদ নদভীর নেতৃত্বে নতুন ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের পর এভাবেই বদলে যাচ্ছে আইআইইউসির চিত্র।

নতুন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবু রেজা নদভী প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর এই বিশ্ববিদ্যালয় ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন। শুরুতেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফকে আইআইউসি’র নতুন উপাচার্য হিসেবে দেওয়া হয় দায়িত্ব। নদভীর নির্দেশে খোলা হচ্ছে মর্ডান সায়েন্স ফ্যাকাল্টির অধীনে আর্কিটেকচার এবং আর্টস এন্ড হিউমেনেটিস অনুষদের অধীনে অ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজ বিভাগ।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড পাবলিকেশনস (সিআরপি) ঢেলে সাজানো হয়েছে। এই সেন্টারের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ভবন। এই সেন্টারে প্রকাশিত সকল জার্নালকে বাংলা, ইংলিশ, আরবী তিন ভাষায় প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য নিয়োগ দেওয়া হয় অক্সফোর্ড, আল আজহার, মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন রিসার্চ ফেলোকে। এই সেন্টারের অধীনে প্রতি তিন মাসে একটি জার্নাল প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এছাড়া জামায়াত নিয়ন্ত্রিত শরীয়াহ ফ্যাকাল্টিতে একযোগে এডহক ভিত্তিতে ১৬ জন প্রগতিশীল ইসলামিক স্কলারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মোরালিটি ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রামের (এমডিপি) পরিচালক পদ থেকে জামায়াতের রুকন বিএম মফিজুর রহমান আল আজহারীকে অব্যাহতি দিয়ে আমীন নদভীকে নিযুক্ত করা হয়েছে। আইআইইউসির সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিবের পদ থেকে জামায়াতের রুকন বিএম মফিজুর রহমানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এই পদে নিযুক্ত করা হয়েছে মক্কা ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক ড. শোয়েব মাক্কীকে। বিএম মফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম কলেজ জামে মসজিদে ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচারের অভিযোগ রয়েছে। পরে ছাত্রলীগের আন্দোলনের মুখে তাকে চট্টগ্রাম কলেজ মসজিদের খতিব পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছিল। এছাড়া জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় এই মসজিদের ইমামকেও অব্যাহতি দিয়ে নতুন ইমাম নিযুক্ত করা হয়েছে।

এছাড়া অনিয়ম ও দুর্নীতির বন্ধের উদ্যোগ হিসেবে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ পর্ষদ হিসেবে খ্যাত জমি ক্রয় কমিটি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পারচেজ এন্ড প্রকিউরমেন্ট কমিটি, প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট ডিভিশন ভেঙে নতুন দায়িত্বশীল নিযুক্ত করা হয়েছে।

এদিকে নতুন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আল্লামা শাহ আবদুল জব্বার (রাহ.) হল, শরীয়াহ ফ্যাকাল্টি ভবন, দ্বিতীয় সায়েন্স ফ্যাকাল্টি ভবন এবং নতুন প্রশাসনিক ভবন। এছাড়া আইআইইউসির বহদ্দারহাট ক্যাম্পাসে এক হাজার আসনের ১৫ তলা ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইআইইউসির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামকে আমরা এশিয়া মহাদেশের জ্ঞানচর্চার একটি সমৃদ্ধ ক্ষেত্র হিসেবে তৈরি করতে চাই। শিক্ষার্থীদের মেধা ও যোগ্যতা বিকাশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবদান রাখতে পারে সেই উপযোগী একটি প্রতিষ্ঠান আমরা বিনির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমি এই প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে একাডেমিক ও অবকাঠামো উন্নয়ন শুরু করেছি। অবকাঠামো উন্নয়নে ইতোমধ্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প আমরা বাস্তবায়নের চিন্তা করছি। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মননে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালনের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করেছি মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার ও বঙ্গবন্ধু রিসার্চ সেন্টার। যেগুলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে ছিল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয় মৌলবাদী অপশক্তির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। তারা এখান থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এই টাকায় দেশে অরাজকতা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়েছে। এখন থেকে তা আর সম্ভব নয়। তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা নিজেরা লুট করেছে। কোনো উন্নয়ন করেনি। এখানকার কর্মকর্তা, কর্মচারীরাও নিগৃহীত হয়েছে। আমরা দায়িত্ব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছি। এছাড়া বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে এগিয়ে নিতে একাডেমিক সিস্টেম আরও আধুনিক করার সব কার্যক্রম হাতে নিয়েছি আমরা। ইউজিসি ইতোমধ্যে রেড মার্কিংও তুলে নিয়েছে। আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের মোরালিটি ডেভেলপমেন্টের জন্যও বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!